২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬: আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার পিলখানা ট্র্যাজেডি’র সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে । ২০০৯ সালের এই দিনে তৎকালীন বিডিআরের কিছু বিপথগামী সদস্য নির্মমভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস কর্মকর্তাকে হত্যা করে।
ওই দিন সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে বিডিআরের বার্ষিক দরবার চলাকালে হলে ঢুকে পড়ে একদল বিদ্রোহী সৈনিক। এদের একজন তৎকালীন মহাপরিচালকের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। এরপরই ঘটে যায় ইতিহাসের সেই নৃশংস ঘটনা।
বিদ্রোহী সৈনিকরা হাতিয়ার নিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা কর্মকর্তাদের হত্যা করে তাদের পরিবারকে জিম্মি করে ফেলে। পুরো পিলখানায় এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চারটি প্রবেশ গেট নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আশেপাশের এলাকায় গুলি ছুঁড়তে থাকে তারা। বিদ্রোহীরা দরবার হল ও এর আশপাশ এলাকায় সেনা কর্মকর্তাদের গুলি করতে থাকে। তাদের গুলিতে একে একে লুটিয়ে পড়তে থাকেন সেনা কর্মকর্তারা।
ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পর এ বিদ্রোহের অবসান হয়। পিলখানা পরিণত হয় এক রক্তাক্ত প্রান্তরে। পরে বিডিআর কমপাউন্ডে আবিষ্কৃত হয় গণকবর। সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। এ হত্যাযজ্ঞে ৫৭ কর্মকর্তা, একজন সৈনিক, দুই কর্মকর্তার স্ত্রী, ৯ বিডিআর সদস্য ও পাঁচ জন বেসামরিক লোক নিহত হন।
পিলখানায় এই বিদ্রোহের ঘটনায় বিডিআরের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। শুরু হয় বিডিআর পুনর্গঠনের কাজ। বিডিআরের নাম, পোশাক, লোগো ও সাংগঠনিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়। বিডিআর-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। পরিবর্তন করা হয় বিদ্রোহের আইন।
এ ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি লালবাগ থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। পরে মামলা দুটি নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। হত্যা মামলায় অভিযোগপত্র দাখিলের পর রাজধানীর লালবাগের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ আদালতে বিচার করা হয়। বিচার শেষে ২০১৩ সালে ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ড. মো. আখতারুজ্জামান। মামলার আসামি ছিল ৮৪৬ জন।
এ মামলায় উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) তৌহিদুল আলমসহ ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দীন আহম্মেদ পিন্টু (কারাগারে মৃত্যু), স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে আরো ২৫৬ জনকে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন ২৭৭ জন।
নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে কারাবন্দি ১৩৮ জন ফাঁসির আসামিসহ অপরাপর আসামিরা হাইকোর্টে আপিল করেন। একইসঙ্গে নিম্ন আদালত থেকে ফাঁসির দণ্ড অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় ডেথ রেফারেন্স। পরে আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়। এই মামলার শুনানির জন্য সুপ্রিমকোর্ট বিশেষ উদ্যোগ নেয়। বিশেষ ব্যবস্থায় এ মামলার ৩৭টি পেপারবুক তৈরি করা হয়। প্রতিটি পেপারবুক ৩৭ হাজার পৃষ্ঠার ওপরে।
এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৫২ আসামির মধ্যে ১১৪ জনের ক্ষেত্রে মামলার বিষয়বস্তুর উপর আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হয়েছে। বাকিদের ক্ষেত্রে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই বিষয়বস্তুর উপর আসামিপক্ষে যুক্তি উপস্থাপন শেষ হতে পারে।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, মামলায় বিচার প্রক্রিয়া যেভাবে চলছে তাতে আগামী ২/৩ মাসের মধ্যে বিচার শেষ হতে পারে।
আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলামও অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, যেভাবে বিরতিহীনভাবে বিচার প্রক্রিয়া চলছে তাতে মে মাসের আগে এর বিচার শেষ হবে না। তবে সবমিলে আরো ২/৩ মাস লাগতে পারে।
ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানিয়াছেন নিহতদের স্বজনরা
বিডিআর ট্র্যাজেডির ঘটনায় নেপথ্য মদতদাতা হিসেবে ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানিয়েছেন শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরা। একই সঙ্গে তারা ২৫শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে সরকারিভাবে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানান। গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে পিলখানা শহীদদের স্মরণে এক আলোচনা সভায় শহীদ পরিবারের স্বজনরা এসব দাবি জানান। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আলোচনা সভা শেষে শহীদ পরিবারের সদস্যরা মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রেস ক্লাব চত্বরে আলোর মিছিলে শরিক হন। শহীদ পরিবারবর্গ ও দেশ উই আর কন্সার্নড নামে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল তার বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশ অর্জন করতে হয়েছে অনেক রক্তের বিনিময়ে, রক্ষাও করতে হচ্ছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। পিলখানায় যে সেনা সদস্যদের হত্যা করা হয়েছে, এই ক্ষত কোনো দিন সেরে উঠবে না। তিনি বলেন, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয়টি লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কিন্তু একটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে এর পেছনের ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে আমরা কিছুই জানতে পারলাম না। সুলতানা কামাল বলেন, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডের শেষটা যদি জানতে না পারি তাহলে জাতি হিসেবে এই আফসোস আমাদের থেকে যাবে।
আলোচনা সভার শুরুতেই স্বাগত বক্তব্য দিতে গিয়ে পিলখানায় নিহত কর্নেল কুদরত ইলাহীর বাবা হাবিবুর রহমান ছেলের স্মৃতিচারণ করেন। পরে তিনি বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় আক্ষেপ নিয়ে বলেন, আমরা জীবদ্দশায় তো নয়ই, তাদের (পিলখানায় নিহত সেনাকর্মকর্তারা) স্ত্রী-সন্তানরাও এই বিচার দেখে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, শহীদ পরিবারের সন্তানেরা বিচারের যে রায় হয়েছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। একই সঙ্গে বিচারবিভাগীয় একটি তদন্ত কমিশন গঠন করে এই ঘটনার নেপথ্য মদতদাতাসহ পুরো ঘটনা জনসমক্ষে তুলে ধরার দাবি জনান তিনি।
শহীদ কর্নেল মুজিবের স্ত্রী নাসরীন ফেরদৌসি বলেন, আমাদের জীবনে প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিক্ষণই ২৫শে ফেব্রুয়ারি। আমরা দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছি। আমাদের সন্তানদের মন থেকে এখনো ‘ট্রমা’ কাটেনি। আমরা চাই এই দিনটিকে সরকারিভাবে বিশেষ দিবস হিসেবে পালন করা হোক। এর বাইরে আমাদের বিশেষ কিছু চাওয়া নেই। নিহত কর্নেল মুজিবের স্ত্রী নিজের একটি তিক্ত অভিজ্ঞতার উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেখলেই সবাই বলে ‘তোমরা তো সরকার থেকে অনেক কিছু পেয়েছ’। কিন্তু আমরা যা হারিয়েছি তা কি কিছু দিয়ে পূরণ হতে পারে। আর আমরা যা পেয়েছি তা ন্যায্য জিনিস। এর মধ্যে পেনশনের ৫০ শতাংশ এককালীন এবং বাকিটা মাসে মাসে পাচ্ছি। সরকারের কাছ থেকে ঘটনার পর ১০ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। ডিউটিরত অবস্থায় সেনা কর্মকর্তা নিহত হলে বাহিনী থেকে কিছু অর্থ দেয়া হয়, সেটা পেয়েছি। আর যে প্লটের কথা বলা হয় এগুলো মৃত্যুর আগেই পাওয়া। এসব প্রাপ্ত জিনিস কোনোভাবেই অনুদান নয়। ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেন, একমাত্র তারা যে মাসে ৪০ হাজার করে টাকা দেয় সেটি আমার সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে।
শহীদ মেজর মোহাম্মদ সালেহ’র স্ত্রী নাসরীন আহমেদ বলেন, আমার বেশি কিছু বলার নেই আমরা শুধু ২৫শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান জানাই। আর বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিচার যে হয়েছে পুরোপুরি জানতে চাই এই ঘটনার পেছনে কারা ছিল? তাদের উদ্দেশ্য কি ছিল? এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। এজন্য এটুকু আমরা জানতে চাই, আমাদের সন্তানেরা জানতে চায়।
শহীদ মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রীতা রহমান বলেন, ঘটনার দিন এত অফিসার কেন একসঙ্গে ডেকে আনা হলো? যার পোস্টিং ছিল না তাকেও ডেকে আনা হয়েছিল- এর কারণ কি ছিল আমরা সেই কারণটা জানতে চাই। তিনি বলেন, পিলখানায় স্বামী হারানোর তিন বছরের মাথায় আমার একমাত্র ছেলেটা মারা যায়, এর এক বছর পর আমার বাবা মারা যান। আমার মতো সব হারানো আর কেউ হয়তো নেই।