অবৈধ উপায়ে তৈরি ক্ষমতাসীনদের এসব কার্যালয় নিয়ে অনেকটাই অসহায় সরকার। স্থানীয় নেতা ও সাংসদদের মদদ থাকায় কার্যালয়গুলো উচ্ছেদে সাহস দেখাচ্ছেন না ডিসিসি কিংবা সংশ্লিষ্ট ভূমির মালিকপক্ষ
রাজধানীর এফডিসির পশ্চিম পাশে কারওয়ানবাজার রেলগেট সংলগ্ন সড়কের পাশে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে ২৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের ২০নং ইউনিট কার্যালয়। ছবিটি বৃহস্পতিবার তোলা _যাযাদিকর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেই। নেই দলীয় নির্দেশনাও। অথচ সরকারি জমি দখল করে কার্যালয় খুলে বসেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। ইচ্ছা হলেই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে কিংবা স্থানীয় এলাকায় ঘোষণা দিয়ে গড়ে তুলছেন নামে-বেনামের এসব কার্যালয়। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন ঘুরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও শ্রমিকলীগসহ ক্ষমতাসীনদের নামে এমন দুই শতাধিক কার্যালয়ের খোঁজ মিলেছে। রাজনৈতিক দলের অফিস ছাড়াও পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীনদের মদদে তৈরি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবীদের বিভিন্ন সংগঠন।
এদিকে অবৈধ উপায়ে তৈরি ক্ষমতাসীনদের এসব কার্যালয় নিয়ে অনেকটাই অসহায় সরকার। স্থানীয় নেতা ও সাংসদদের মদদ থাকায় কার্যালয়গুলো উচ্ছেদে সাহস দেখাচ্ছেন না ডিসিসি কিংবা সংশ্লিষ্ট ভূমির মালিকপক্ষ। আবার উচ্ছেদ করতে গেলেও বাধা-বিপত্তি ও হেনস্তার শিকার হচ্ছেন। সিটি করপোরেশন কর্মকর্তারা বলছেন, অনুমোদনহীন এসব কার্যালয় উচ্ছেদ করার পর আবার বানানো হয়। তাই উচ্ছেদ করে খুব বেশি লাভ হয় না। ক্ষমতার পালাবদল হলে এসব জমির দখলদারত্ব শুধু বদল হয়।
জানা গেছে, অবৈধভাবে স্থাপিত এসব কার্যালয়ের আড়ালে স্থানীয় নেতারা আখের গোছানোর রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। জড়িয়ে পড়েন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাজার, টার্মিনাল এবং ফুটপাত দখলের লড়াইয়ে। ফলে অনেক সময়ই তারা সংঘাত-সংঘর্ষে জড়িয়ে, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে দল ও সরকারের। যদিও আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের নেতাদের বক্তব্য, অবৈধভাবে কার্যালয় নির্মিত হলে তা উচ্ছেদ করার দায়িত্ব ডিসিসি ও স্থানীয় প্রশাসনের। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। আর কার্যালয়ের আড়ালে চাঁদাবাজির প্রমাণ পাওয়া গেলে দল থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও ভাতৃপ্রতিম সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নামে দুই শতাধিক অবৈধ কার্যালয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে। রেলওয়ে, গণপূর্ত, ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং ডিসিসিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জায়গা দখল করে এসব কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে।
সরেজমিন ঘুরেও দেখা গেছে, রাজধানীর শাহবাগ, আজিমপুর, লালবাগ, পলাশী, ঢাকা মেডিকেল, চাঁনখারপুল, যাত্রাবাড়ী, সায়দাবাদ, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, আগারগাঁও, মিরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, মহখালী, এয়ারপোর্ট, উত্তরাসহ প্রতিটি এলাকাতেই অবৈধ কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে কোনোটি তৈরি হয়েছে রিকশা গ্যারেজ ও হিউম্যান হলার যানকে কেন্দ্র করে, আবার কোনোটি হয়েছে বাস টার্মিনাল থেকে অবৈধ চাঁদা আদায়ের লক্ষ্যে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, শুধু দলীয় কার্যালয় নয়, অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদের ব্যপারে চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। ফুটপাতগুলো উচ্ছেদে একাধিকবার অভিযান চালানো হয়েছে। রাজনৈতিক, সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবীর নামে অবৈধ অফিসগুলোও তুলে দেয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনুমোদন ছাড়াই ছয় মাস আগে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার বিএসটিআই মোড়ে নির্মাণ করা হয় জাতীয় শ্রমিক লীগের ৩৪ নাম্বার ওয়ার্ড কার্যালয়। মোড়জুড়ে টিনশেডে তৈরি এ কার্যালয়ের প্রবেশপথেই রয়েছে রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকল মেরামতের সামগ্রী। আর আশপাশে রয়েছে বেশ কয়েকটি চা-নাস্তার দোকান। গত বুধবার গিয়ে কার্যালয়টি খোলা পাওয়া গেলেও সেখানে উল্লেখযোগ্য কারো দেখা মেলেনি। টেলিভিশন দেখায় ব্যস্ত এক ব্যক্তি জানান, জায়গাটি ফাঁকা ছিল, তাই কার্যালয় বসানো হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মী আসেন, আড্ডা দেন। এর বাইরে কিছু হয় না। অনুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানেন না বলে এ প্রতিবেদককে বলেন। শ্রমিক লীগের এই কার্যালয় ছাড়াও একই এলাকায় রয়েছে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুটি কার্যালয়। আছে ফুটপাত দখল করে স্থাপিত মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড কাউন্সিলের নামে আরেকটি কার্যালয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, মূলত রিকশা গ্যারেজ ও বেগুনবাড়ী এলাকায় গড়ে ওঠা ফুটপাতকে নিয়ন্ত্রণ করতেই ওই কার্যালয়গুলো স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে শ্রমিক লীগের কার্যলয়টি।
কার্যক্রম না থাকলেও একই অঞ্চলের মাদক অধিদপ্তরের সামনের মোড়ে কার্যালয় স্থাপন করেছে ঢাকা মহানগরের ৩৪ নাম্বার মহিলা আওয়ামী লীগ। পাশেই রয়েছে স্পোর্টিং ক্লাবের নামে অপর একটি কার্যালয়। নিজেদের সরকারের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান দাবি করলেও বিষয়টি সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, স্পোর্টিং ক্লাব হলেও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের কাছে কার্যালয়টি কুক্ষিগত হয়ে আছে। ফলে তা এলাকাবাসীর উপকারে আসে না।
কাওরান বাজার রেলক্রসিং (এফডিসি মোড়) সংলগ্ন জমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে ২৪ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের কার্যালয়। রেলওয়ের জমি দখল করে টিনশেড দিয়ে বিশালাকৃতির দুটি ঘর তৈরি করা হয়েছে জায়গাটিতে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে জানান, যুবলীগের নেতাকর্মী অনেক আগে কার্যালয়টি স্থাপন করেছেন। অনিয়ম-অনৈতিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, কার্যালয় যখন হয়েছে, তখন অনিয়ম তো আছেই।
মহাখালীর রেলগেটসংলগ্ন ফুটপাতের মাসোয়ারা আদায় করতে রেলের জায়গা দখল করেই নির্মাণ করা হয়েছে ২০ নাম্বার ওয়ার্ড শাখা আওয়ামী যুবলীগের পাকা স্থাপনার কার্যালয়। আর লেগুনা ও গণপরিবহনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে তৈরি হয়েছে জাতীয় শ্রমিক লীগের অফিস। আধিপত্যের সংঘাতে টিকে থাকতে ২০১২ সালের মাঝাদিকে এ কার্যালয়ে ঢুকেই অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ তিনজনকে গুলি করে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর তৎকালীন সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লীউন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক রাজধানীর রাজনৈতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সব অবৈধ কার্যালয় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উচ্ছেদের নির্দেশ দেন। কিন্তু এরপর তিন বছর পার হয়ে গেলেও সেই ঘোষণার বাস্তবায়ন আজও হয়নি। কিছু এলাকায় উচ্ছেদ অভিযান চললেও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে ক্ষমতাসীন দলের কার্যালয়গুলো বহাল থেকে যাচ্ছে।
তেজগাঁও, মহাখালী ছাড়াও রাজধানীর ওয়্যারলেস গেটের পাশে ২০ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, তেজগাঁও রেলস্টেশনের পাশে রেলওয়ে শ্রমিক লীগ, কুড়িল বিশ্বরোড রেলক্রসিংয়ে পাশে শ্রমিক লীগের ১৭ নাম্বার ওয়ার্ড কমিটিসহ স্টেশনস্থ প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই ক্ষমতাসীনদের কার্যালয় বানানো হয়েছে।
আগারগাঁও এলাকায় পাসপোর্ট অফিস এলাকায় শেরেবাংলানগর থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যালয় তৈরি করা হয়েছে। পাশেই স্থাপন করা রয়েছে ৪১ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কার্যালয়। মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের প্রধান ফটকের পশ্চিম পাশে মিরপুর থানা ছাত্রলীগের নামে অবৈধ কার্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে। মতিঝিলে জীবন বীমা ভবনের পাশে পাকা স্থাপনায় রয়েছে যুব শ্রমিক লীগের কার্যালয়। যাদের বিরুদ্ধে সন্ধ্যার পর আশপাশের ফুটপাতের দোকান থেকে চাঁদা তোলার অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিক লীগের ৮ নাম্বার ওয়ার্ড কমিটির কার্যালয় রয়েছে একই এলাকার রেলের জমিতে। এছাড়া শাহবাগে ৫৭ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের ৫ নাম্বার পাবলিক লাইব্রেরি ইউনিট শাখা, শিশুপার্কের জায়গায় ২০ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ পার্ক এভিনিউ ইউনিট, সদরঘাটস্থ বাবুবাজার ব্রিজের পাশে শ্রমিকের কার্যালয় গড়ে তোলা হড়েছে।
কাঁচা-পাকা স্থাপনায় অবৈধভাবে তৈরি এসব কার্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, স্টেশনসংলগ্ন এলাকার ফুটপাত ও ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেই মূলত কার্যালয়গুলো নির্মাণ করা হয়েছে। পাশাপাশি কার্যালয়ের বিরুদ্ধে নগর পরিবহনের কাউন্টার থেকে চাঁদা তোলারও ঢের অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগের পর বিএনপি আবার বিএনপির পর আওয়ামী লীগ- ক্ষমতার পালাবদলে এভাবেই চলছে অবৈধ উপায়ে নির্মিতি এসব কার্যালয়ের কার্যক্রম।
এ ব্যাপারে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, জমি দখল করে নির্মিত অবৈধ কার্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা নেই। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনই ব্যবস্থা নেবে।
দখল চলছে ডিসিসির নামেও: এদিকে ক্ষমতাসীন দলের পাশাপাশি ডিসিসির নামেও চলছে ফুটপাত দখল। বর্জ্য পরিষ্কারকদের হাজিরা নেয়ার জন্য প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই গড়ে তোলা হয়েছে ‘হাজিরাঘর’ নামে কাঁচা-পাকা স্থাপনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর কাওরান বাজার থেকে চাঁনখারপুর ও পলাশী থেকে কাঠালবাগান এলাকা নিয়ে গঠিত ২১ নাম্বার ওয়ার্ডে মোট পরিষ্কারকের সংখ্যা ৯৭ জন। এদের প্রত্যেককে হাজিরার জন্য দিনে অন্তত একবার হাজিরা ঘরে যেতে হয়। বুয়েট মসজিদের উল্টো পাশে অবস্থিত এ ঘরটিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ফুটপাত দখল করে টিনশেড দিয়ে স্থাপনাটি নির্মাণ করা হয়েছে। ২১ নাম্বার ওয়ার্ড বর্জ্য পরিষ্কার পরিদর্শকের দায়িত্বে নিয়োজিত ডিসিসির এক কর্মকর্তা জানান, ‘সত্যিকার অর্থে কোনো অবৈধ কাজ হয় না। তবে হাজিরা ঘরকে ঘিরে আশপাশে দু-একটি দোকান বসানো হয়, যেগুলো সংশ্লিষ্টরা নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন।’ তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় হাজিরা ঘরগুলো অনেক ছোট। হাজিরা দিতে সব শ্রমিকের স্থান ঘরে সংকুলন হয় না। অনেক সময় পরিষ্কারের দ্রব্যাদিও রাখার জায়গা পাওয়া যায় না বলে জানান তিনি।
তবে বিষয়টি নিয়ে আশপাশে থাকা অনেকেই আপত্তি জানান। বুয়েট শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, পরিষ্কারের জন্য এ ধরনের কক্ষ প্রয়োজন আছে। তবে তা ফুটপাত দখল করে নির্মিত হওয়ায় অনেক সময়ই অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। ডিসিসি পরিকল্পিত উপায়ে কাজটি করলে ভালো হতো বলে তিনি অভিমত দেন। শুধু ২১ নাম্বার ওয়ার্ড নয়, রাজধানীর ১৩, ১৭, ২৩, ২৪, ২৭, ৩৩ নাম্বার ওয়ার্ডসহ অনেক এলাকাতেই ফুটপাত দখল করে বর্জ্য পরিষ্কারকদের এই ঘর নির্মাণ করা হয়েছে বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে।
[Adverts]