ভালবাসার পরিচর্যা !!
প্রেক্ষাপট -১)
এক ভদ্রলোক অনেক প্রতীক্ষার পর বাবা হবার সৌভাগ্য অর্জন করলেন ! ৬ বছর প্রেম করার পর ভালবাসার মানুষটিকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে বিয়ে করে সংসার শুরু করে ছিলেন ! বিয়ের পর থেকেই স্বামী-স্ত্রী খুব একটা সুখের সংসার করছিলেন না ! প্রায়ই তাদের ঘরে খুনসুটি বা ঝগড়া চলত ! সামান্য কিংবা বড় কারণে ‘বিবাদ’ যেন ‘খাবার’ এর মতই নিত্য দিনের সাথী হয়ে গিয়েছিল তাদের সংসারের ! এই ভাবে চলতে চলতেই এক কন্যার জন্ম হয় ! কিন্তু তারপর ও ‘বিবাদ’ যেন তাদের সংসার থেকে কোনো ভাবেই বিদায় নিতে পারেনি ! আরো কিছু দিন এই ভাবে চলার পর এক সময় এই পরিবারটি ভেঙ্গে যায় ! কারণ সেই পরিবারটির কাছে ‘বিচ্ছেদ’ কেই এই সকল সমস্যার সমাধান বলে মনে হয় ! পারিবারিক কলহ সাধারণত যেসব কারণে হয়ে থাকে – ভালবাসা / পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব, দাম্ভিকতা, সুশিক্ষার অভাব, মিলে মিশে কিংবা ভাগাভাগি অথবা কম্প্রমাইজ এর অভাব, আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা শারীরিক ত্রুটি ইত্যাদির অভাবে ! এই পরিবারের ক্ষেত্রে আমার জানা মতে ভালবাসা, পারস্পরিক শ্রদ্ধার অভাব আর দাম্ভিকতা দায়ী ! এক্ষত্রে বলা প্রয়োজন, স্বামী যথেষ্ঠ শিক্ষিত আর উঁচু পর্যায়ে চাকুরী করলেও স্ত্রীও সমপর্যায়ে শিক্ষা আর চাকুরী পদ সমমানের তাই হয়ত এ সমস্ত দিক গুলোর অভাব জন্মাতে জন্মাতে তা ক্রমসই বেড়ে চলে ছিল ! সঙ্গে সঙ্গে ভালবাসার মৃত্যু ঘটে তাই দুক্ষজনক ভাবে এমন পরিনতি !
প্রেক্ষাপট – ২)
বাবা- মায়ের বড় আদরের একমাত্র মেয়ে ! কত স্বপ্ন কত আশা কত ভরসা এই মেয়েকে ঘিরে ! মেয়েকে জীবনের যত আয় সবই তার উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য ব্যয় করতে সেই বাবা মায়ের কোনও কার্পন্য চোখে পড়েনি ! যখন যা চেয়েছে সঙ্গে সঙ্গে তা হাজির ! ভালো স্কুল, ভালো কলেজ, ভালো ইউনিভার্সিটি সর্বত্র সর্বোচ্চ সব কিছু ! বাবা মা উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবন ধারণ করলেও মেয়েকে একেবারে উচ্চবিত্ত আভিজাত্যের পর্যায়ে বড় করেন ! এতে মেয়েটি স্বাভাবিক ভাবেই এই আভিজাত্যকে অতি সহজ আর সাধারণ ভাবে ! এরই ফলস্বরূপ মেয়েটি অনেকটা উস্রিংখলতায় আচ্ছন্ন হয়ে পরে ! তাই স্বাভাবিক ভাবেই তার শিক্ষাকে উপযুক্ত কাজে লাগাতে পারেনি ! বাবা- মায়ের কষ্টের ও সীমা থাকলো না ! বাবা – মা এবং সন্তানের মাঝে ভালোবাসাহীন এক বিরাট কষ্টের পাহাড় খাড়া হয়ে রইলো !
প্রেক্ষাপট – ৩)
এক বিধবা মা তার অতি অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে একটি পুত্র ও একটি কন্যাকে নিয়ে বলা যায় অথৈ সমুদ্রে পড়ে গিয়ে ছিলেন ! স্বামীর পেনশন, আর সীমিত কিছু সঞ্চয় সঙ্গে কোনো রকমে ছোট খাটো স্কুল চাকুরী করে বড় কষ্টে জীবন যুদ্ধে নিজেকে সপে দিয়ে ছিলেন ! এই যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ছেলে-মেয়েকে প্রয়োজনীয় সুশিক্ষা দিতে সক্ষম হয়ে ছিলেন ! তারপর মেয়েটিকে একটা সুপাত্রের হাতে তুলে দিয়ে একমাত্র ছেলের জন্য ও লাল টুকটুকে বউ নিয়ে আসলেন ! বাবাকে হারিয়ে মায়ের কাছে বাবা-মার দুজনের ভালবাসা পেয়ে বড় হওয়া ছেলে মেয়েটি জীবন কিংবা মায়ের ভালবাসার অবদান মনে রেখেছিল ! তাইত একটা সময় যেই মায়ের কাছে অফুরন্ত ভালবাসা পেয়েছে আজ মায়ের এই মধ্য কিংবা শেষ বয়সে মাকে সেই ভালবাসা দিতে আপ্লুত দুই ভাই বোন ! এই ভালবাসার মাঝে যেন এক অলিখিত নি:স্বার্থ প্রতিযোগিতা ! এমন একটি পরিবার আর মাকে দেখে যারপর নাই আনন্দ পেয়ে ছিলাম ! এ এক অপার শান্তি নি:সন্দেহে ! এখানে ভালবাসা আর শ্রদ্ধার পরিপূর্ণতা তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না !
প্রেক্ষাপট -৪)
আমরা মানুষ যে যেই ধর্মের, বর্ণের, কিংবা যেই দেশের বাসিন্দা হইনা কেন আমরা সবাই কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী কিংবা ধর্মহীন ! আমরা যে একা একাই পৃথিবীতে চলে আসিনি এটা নিশ্চই আমরা ভাবি এবং বুঝতে পারি ! আমাদের সবার মনে এই বিশ্বাস কাজ করে আমাদেরকে কেও সৃষ্টি করেছেন ! একজন প্রকৃত মুসলিম হিসেবে আমি আমার বিশ্বাসটাই বলছি ! যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ! শুধু সৃষ্টিই নয়, পৃথিবী সৃষ্টি থেকে শুরু করে, আলো, বাতাস, চাঁদ, সূর্য, বৃক্ষ, জীব, আমরা মানুষ সব কিছু সব… ! এগুলো বলে কখনই শেষ করতে পারব না ! আমাদের উত্তম আহার, বাসস্থান, জীবন, জীবিকা প্রতিটি মুহূর্ত শুধু মাত্র সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপা ! আলহামদুলিল্লাহ ! যিনি এত কিছু দিয়েছেন প্রতিটি মুহুর্তে দিচ্ছেন সেই সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের করণীয় কি হতে পারে তা আমরা রাসুল (স:) এর মুখের বাণী, পবিত্র কোরান আর হাদিসের আলোকে জানি ! এই ব্যপারে আমরা যে যার মত পারি তা পালন করার চেষ্টা করে থাকি ! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের রাসুল মুহাম্মদ (স:) এর মাধ্যমে আমাদের পথ দেখিয়ে দিয়েছেন কি করে ইবাদত এর দ্বারা আমরা তার গুনগান কিংবা ভালবাসা জানাতে পারি !
প্রেক্ষাপট – ৫)
এক ভাইকে খুব অল্প বয়সে তার বাবাকে হারিয়ে মা, ছোট এক ভাই -বোনকে পালন করার দায়িত্বে নিয়োজিত হতে হয় ! কারখানাতে কাজ করে বড় কষ্টে ভাই বোনকে পড়াশোনা করানো, মায়ের সেবা সহ সংসার ! এইভাবে চালাতে গিয়ে নিজের জীবনের অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত অথবা দেরীতে প্রাপ্তি ঘটলেও একটা সময় পরিবারে সুশৃঙ্খলা আনতে সক্ষম হয় ! হয়ত তখন প্রিয় মাকে হারাতে হয় ! ছোট ভাই আর বোনের কাছে এই বড় ভাইটি সারা জীবনই বাবা হিসেবেই ছিল ! বড় ভাইয়ের আত্মত্যাগ তাদের গর্বিত করত ! তাদের ভালবাসায় বড় ভাইটিও গর্বিত অনুভব করত ! এখানে ছিল অগাধ ভালবাসা, শ্ব্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা !
এতক্ষণ আমি আমার দেখা শোনা বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখলাম ! আমার দেখা কিছু বাস্তব চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করলাম ! কিছু চিত্র দুখের কিছু চিত্র সুখের ! প্রতিটি চিত্রের কমন বিষয় হচ্ছে ভালবাসা ! কোথাও ভালবাসার ছড়াছড়ি আবার কোথাও ভালবাসার অভাব ! আমি নিশ্চিত এর মাঝে যেখানে ভালবাসা ভরপুর কিংবা সুখের প্রেক্ষাপটটা পড়তে পাঠকের বেশি ভালো লেগেছে ! এমনকি আমার ও সেই প্রেক্ষাপট টি লিখতে বেশি ভালো লেগেছে ! এর কারণ কি বলতে পারেন ? আমরা সবাই সুখের কিংবা ভালবাসার কাঙ্গাল ! আমরা সবাই ভালবাসা চাই ! এই ‘ভালবাসা’ এমনি এক জিনিস ! আমাদের সৃষ্টিকর্তা তিনিও একে বড় ভালবাসেন ! আমাদের মাঝেও তা ছড়িয়ে দিয়েছেন ! কিন্তু আমরা বেশিরভাগ মানুষ আমাদের সংকীর্ণতায় এই ভালবাসা পেতে বেশি ভালোবাসি কিন্তু দিতে নই ! অথচ এই ভালবাসাকে পরিচর্যার বড় প্রয়োজন ! প্রয়োজন রক্ষনা বেক্ষনের, যত্নের ! সৃষ্টিকর্তাকে যত বেশি ভালবাসা আমরা দেই এতে আমাদের ভালবাসা তত মজবুদ হয়, ছোট শিশুকে আমরা মায়েরা কত আদর- যত্ন, ভালবাসা আর মমতা দিয়েই না বড় করে তুলি ! বাগানের চারা গাছ গুলোকে পরিচর্যা করে যত্নে যত্নে কত বড় করার চেষ্টা করি ! ঠিক তেমনি এই ভালবাসা থাকে পিতা-মাতার সাথে সন্তানের, ভাই- ভাই কিংবা বোন- বোন নতুবা ভাই – বোন, স্বামী- স্ত্রী, বন্ধুতে, ইত্যাদি পৃথিবীর যেকোনো সম্পর্কে ! এই ভালবাসাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়নের প্রয়োজন ! একে ধরে রাখার প্রয়োজন ! এই পরিচর্যার অভাবে আমাদের ছোট শিশু যেমন অসুস্থ হয়ে পড়ে, বাগানের গাছ কিংবা বৃক্ষ মরে যায় তেমনি ভালবাসার মৃত্যু ঘটে ! একটু যত্নের অভাবে আজ পৃথিবীর অনেক মূল্যবান সম্পর্ক ভেঙ্গে যাচ্ছে ! ভেঙ্গে যাচ্ছে সুখের বন্ধন ! তৈরী হচ্ছে সম্পর্ক ফাটলের এক বিশাল পাহাড় ! আমাদের একটু খানি সদিচ্ছায় তৈরী হতে পারে সৃষ্টিকর্তার দেয়া দুনিয়াতে এক মূল্যবান জীবন !
সৃষ্টিকর্তা যে আমাদের প্রত্যেক কে সুন্দর হৃদয় দান করেছেন আমি নিশ্চিত ! এব্যপারে যদি একটু হাদিসের আলোকে দেখি তবে বলতে হয়, ১) রাসুল (স:) বলেছেন, “কেও যদি তার পিতা-মাতার দিকে ভালবাসার দৃষ্টিতে তাকায় তবে এক হজ্জের সওয়াব পাবে ” হাদিস নম্বর-৭৬১১ ! ২) “কারো দিকে হাসি মুখে তাকানো ও সুন্নত আদায় হয়” ! ৩) রাসুল (স:) বলেছেন, “তোমরা একে অপরকে উপহার প্রদান কর, তোমাদের পরস্পর ভালবাসা বৃদ্ধি পাবে !” মুয়াত্তা-১৪১৩ ! সুতরাং একে আমরা আমাদের পারস্পরিক ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় আনন্দময় করে তুলতে পারি !
আসুন অন্তত আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালবাসাকে আরও মজবুদ করার মাধ্যমে আমাদের নিজেদের যার যার পিতামাতা, ছোট পরিবার থেকে শুরু করে পরিজন, বন্ধু যত টুকু পারি আমাদের ভালবাসায় আচ্ছাদিত করে তুলি ! প্রতিটি ভালবাসার সম্পর্ককে ধৈর্যের সাথে পরিচর্যা করে তুলতে পারি গভীর মমতায় ! পৃথিবীকে ভালবাসার মায়ায় ভরে তুলতে পারি ! যদিও কখনো অপর দিকে এর হাতছানি স্বল্প থাকলেও, তারপর ও আপনার ভালবাসায় বুঝিয়ে দিন ‘ভালবাসার প্রয়োজনীয়তা আর মূল্যায়ন’ ! এ ভালবাসা ছড়াতে খুব আয়োজনের প্রয়োজন হয় না শুধু মাত্র নূনতম অন্তরের সুদৃষ্টির সাথে মুখের কথা, কাজ কিংবা উপহারই যথেষ্ট ! এই ভালবাসা দিয়ে যেকোনো উপায়েই বুঝিয়ে দিতে পারেন আপনার প্রিয়জনকে ! বর্তমানের এই উন্নত প্রযুক্তির যুগে ভালবাসা পৌছানো অনেক সহজ ! এত সুযোগ সুবিধা পেয়েও আমাদের ভালবাসা দিতে কত কার্পন্য ! সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে ন্যায্য ভালবাসায় আবৃষ্ট করে রাখুক মন থেকে এই কামনা রইলো !