চলচ্চিত্র কি জিনিস মাথায় ছিল না কখনো; কিন্তু ইউরোপে পড়াশোনা করার ফলে একদিন অভিনয়ের নেশা ঢুকে যায় মাথার ভেতর। তারপরও বিষয়টি এতো সিরিয়াসলি নেননি তিনি। গণিত আর পদার্থবিদ্যায় জ্ঞান অর্জন করে কীভাবে একজন মানুষ অভিনয়ের প্যাশন মাথায় বহন করে ঘুরে বেড়ায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারেন মিশরিয় অভিনেতা এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রে এক প্রাজ্ঞজন ওমর শরিশরিফ।
ওমর শরিফ, শুধু একজন মিশরীয় অভিনেতাই নন, বিশ্ব চলচ্চিত্রের এক প্রভাবশালী অভিনেতাও বটে। অভিনয়ের ঝোঁক থেকে হঠাৎ একদিন রিয়েল লাইফ থেকে রিল লাইফে ঢুকে পড়েন অভিনয় সাম্রাজ্যের এই মহান পুরুষ। তার আগে অভিনয়ের ওপর পড়াশোনাও করেন তিনি। লন্ডনে নাট্যকলার ওপর পড়ালেখা করে নিজভূম মিশরে ফেরেন। ১৯৫৪ সালে মিশরীয় ‘শাইতান আল সাহারা’ মানে ‘ডেভিল অব দ্য ডেজার্ট’ নামের ছবিতে প্রথম অভিনয়ও করেন। গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে না হলেও নিজের অজান্তেই যেন ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার দাঁড়িয়ে যায় চলচ্চিত্রের পথে। ছোট্ট চরিত্র, তারপরও তার অভিনয় ক্ষমতায় মুগ্ধ হন স্বয়ং নির্মাতা ইউসুফ চাহিনী। সে বছরেই তাকে আরেকটি সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের জন্য কাস্ট করেন ইউসুফ। মাত্র একটি ছবিতে ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে যাবেন ভাবতে পারেননি ওমর! তবে তিনি যে সেই সক্ষমতা রাখেন, তা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে
প্রকৃতপক্ষে তার দ্বিতীয় ছবি ‘স্ট্রাগল ইন দ্য ভেলি’র মধ্য দিয়েই রিল লাইফ এবং রিয়েল লাইফে গতি সঞ্চার করে। ‘স্ট্রাগল ইন দ্য ভেলি’ ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন ওমর শরিফ। নানান কারণেই এই ছবিটিকে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে বা লিখনীতে তিনি তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দিক বলে উল্লেখ করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ এইজন্য না যে, কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে এটি তার প্রথম ছবি। মূলত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে এই ছবিতে অভিনয় করতে যেয়েই প্রথম প্রেমে পড়েন ওমর শরিফ!
ছবিটিতে প্রথমবার অভিনেতা ওমর শরিফের সাক্ষাৎ হয় সেই সময়ের জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত অভিনেত্রী ফাতেন হামামার সাথে। যার রূপে মুগ্ধ ছিলেন সে সময়ের মিশরীয় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খ্যাতিমান তারকারাও। সেই হিসেবে চলচ্চিত্রে নবাগত ওমর শরিফ ছিলেন চুনোপুঁটি। ওমর শরিফ যখন তার দ্বিতীয় ছবি করতে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন, ফাতেন তখন চল্লিশোর্ধ ছবিতে অভিনয় করে ফেলেছেন। ওই ছবিতে একটি দৃশ্যে প্রেমিক-প্রেমিকার দৃশ্যে ওমর এবং ফাতেন –এর চুমুর দৃশ্য ছিল। প্রথমে ওমর দৃশ্যটি নিয়ে ইতস্তত করছিলেন। কারণ এর আগেতো এমন পরিস্থিতে তাকে পড়তে হয়নি। কিন্তু কী আর করা! অভিনয়ের জন্যতো তাকে চুমুটি দিতেই হবে। তাছাড়া ফাতেনতো দেখতেও ছিলেন বেশ আবেদনময়ী, যার একটু স্পর্শ পেতে তার চারপাশে ঘুরঘুর করতো খ্যাতিমানরা। অথচ তার পিছু না দৌড়িয়েও ওমর এমন সুযোগটি পেয়ে গেলো! ইতস্ততবোধ শেষে অবশেষে ক্যামেরার সামনে ফাতেনকে চুমু দিতে দাঁড়িয়ে গেলেন ওমর। খুব সুন্দরভাবে ইউসুফ তা ক্যামেরাবন্দি করলেন। কিন্তু পর্দার এই চুমু ওমর শরিফ আর ফাতেনের বাস্তব জীবনে ব্যাপক প্রভাব রেখে যায়।
এক চুমু দিয়েই প্রেমে হাবুডুবু খান তারা। তাদের প্রেম আরো গাঢ় হতে থাকে। এক সময় তারা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করবেন। কিন্তু তাদের ধর্মতো এক নয়। ফাতেন মুসলিম ঘরের সন্তান, অন্যদিকে ওমর খ্রিস্টান ক্যাথলিক ঘরের সন্তান। ফলে যা হয়, ওমর তার জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্ম ত্যাগ করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করেন। মাইকেল দিমিত্রি চালহব হয়ে যান ওমর শরিফ। ১৯৫৫ সালেই পরস্পর সংসারবদ্ধ হন। ১৯৫৭ সালে তাদের একটি ছেলে হয়, নাম তারেক আল শরিফ। কিন্তু এতো সাধের সম্পর্কও একদিন ভেস্তে যায়। মাত্র দশ বছর একসাথে বসবাসের পর পরস্পর আলাদা হন তারা। ১৯৭৪ সালে তাদের মধুর সম্পর্কের জবানিকাপাত ঘটে। ওমরকে ডিভোর্স দেন ফাতেন। কিন্তু স্ত্রী ফাতেনের ছেড়ে যাওয়া ওমরের মধ্যে এক গভীর রেখাপাত করে। যার জন্যে ধর্মকর্ম ত্যাগ করলেন, যাকে ভালোবেসে বিয়ে করলেন তার এভাবে ছেড়ে যাওয়া মেনে নিতে পারলেন না তিনি। ফলে এরপর কোনো নারীর সাথে ওমর শরিফ সম্পর্কে জড়িয়েছেন, এ কথা আর শোনা যায়নি। এমনকি তিনি যতদিন জীবিত ছিলেন অন্য নারীকে বিয়েও করেননি। একাকী নিঃসঙ্গ কেটেছে তার রাতদিন…!
ভালোবাসার মানুষ তাকে ছেড়ে গেলেও নাম, যশ, খ্যাতি তাকে ছেড়ে যায়নি। বরং মিশরের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি লাভ করতে থাকেন। ব্রিটিশ মেধাবী নির্মাতা ডেভিড লিনের হাত ধরে বিশ্ব চলচ্চিত্রের পথে যাত্রা করেন ওমর শরিফ। অভিনয় করেন ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ ছবিতে। এ ছবিতে অভিনয় করা নিয়েও আছে নাটকীয়তা। কারণ ওমর শরিফ যে চরিত্রটিতে অভিনয় করেছিলেন, এটি আসলে করার কথা ছিল তখনকার ভারতীয় সিনেমায় তুমুল জনপ্রিয় অভিনেতা দিলীপ কুমারের। কিন্তু কীভাবে যেনো ভাগ্যক্রমে তা এসে গেল ওমর শরিফের হাতে। তবে যাই হোক, ডেভিড লিনের এই ছবিতে অভিনয় করে বিশ্ব খ্যাতি অর্জন ছাড়াও ওমরের ক্যারিয়ারে জোটে অস্কারের মতো সর্বোচ্চ স্বীকৃতি এবং বেস্ট সাপোর্টিং রোলের জন্য জিতে নেন গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড।
ডেভিড লিনের ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’র পর ওমর শরিফ একে একে করেন ফ্রেইড জেইনম্যানের ছবি ‘বিহোল্ড এ পেল হর্স’, যুগোস্লাভিয়ার যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত ছবি ‘ইয়েলো রোলস রয়েস’, মঙ্গোলীয় দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিস খানকে নিয়ে করা ‘চেঙ্গিস খান’, জার্মান জেনারেলের জীবনী নিয়ে নির্মিত ছবি ‘দ্য নাইট অব দ্য জেনারেলস’ এবং আর্জেন্টাইন প্রলেতারিয়েত ও কিউবা বিপ্লবের জনক আর্নেস্টো চে গুয়েভারার জীবনী নিয়ে নির্মিত প্রথম ছবি ‘চে!’। তবে ওমর শরিফ অভিনীত তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সমাদৃত এবং গুরুত্ব বহন করা ছবি বলা হয় ‘ডক্টর জিভাগো’। বরিস পাস্তরনাকের লেখা উপন্যাসের চিত্রায়ন এটি। সেট সাজানো হয় পুরো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রাশিয়ান বিপ্লবের। এটির পরিচালকও ডেভিন লিন। ছবিটি সেসময় দারুণ ব্যবসাসহ সমালোচকদেরও বাহবা কুড়ায়। অস্কারের বিভিন্ন শাখায় ছবিটি জিতে নেয় একাধিক পুরস্কার; কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে যার জন্যে ছবিটি এতো সমাদৃত হলো তাকেই সেরা অভিনেতার পুরস্কার বঞ্চিত করলো অস্কার কর্তৃপক্ষ। তবে সে ছবিতে অভিনয়ের জন্য ‘সেরা অভিনেতা’ হিসেবে জিতে নেন ‘গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড’।
হলিউডে প্রবেশ করার ফলে ওমর শরিফ এক অন্য দুনিয়ার স্বাদ পেয়েছেন বটে, তবে একাকিত্ব ঘোচেনি। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘হলিউড আমাকে সম্মান দিয়েছে,তার সাথে সাথে আরো একাকিত্বও দিয়েছে। এখানে আসার পর আমি আমার ভূমি, আমার দেশের পরিচিত মুখ আর নিজের স্বদেশকে খুব মিস করি। তাদের সঙ্গ অনুভব করি সব সময়।’
হ্যাঁ, তাই শেষ জীবনে তিনি নিজের দেশেই ফিরে এসেছিলেন। একমাত্র ছেলে আর নাতি নাতনীদের সাথে খুব চমৎকার সময় কাটিয়েছেন। কিন্তু বরিস পাস্তেরনাকের উপন্যাসের নায়কের মতোই নিঃসঙ্গ মৃত্যু হলো তার; এবং নিজ ভূমেই। ৮৩ বছর বয়সে কায়রোর হাসপাতালে ১০ জুলাই এই মহান অভিনেতা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একই বছরের জানুয়ারির ১৭ তারিখে মৃত্যু হয় তার একমাত্র সহধর্মীনি ফাতেনেরও, যাকে সিনেমায় চুমু খেয়ে রিয়েল লাইফের সঙ্গী করে ফেলেছিলেন।
London Bangla A Force for the community…
