পুরনো ঢাকার প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মৃত্যুর ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। যে কোন সময় ঘটতে পারে নিমতলীর মত বড় কোন দুর্ঘটনা। ২০১০ সালের ২ জুন রাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে নিমতলীতে। আর কয়েকদিন পরেই নিমতলী ট্রাজেডির পাঁচ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কোন একটি কারখানা বা বাড়িতে আগুন লাগার পরই শুরু হয় পুলিশ-ফায়ার কর্মী আর সরকারের দৌড়ঝাঁপ। তদন্তও শুরু হয়। তোড়জোড় শুরু হয় কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার। এ পর্যন্তই শেষ! আর কোন পদক্ষেপ নেই। এর মধ্যদিয়েই বুটপলিশ ও উপ-বুটপলিশের নামে ছাড়পত্র নিয়ে প্রতিমাসে চীন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নিয়ে আসা হচ্ছে শত কোটি টাকার বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ। এরপর প্রকাশ্যে কখনো আইনসম্মতভাবে, কখনো বেআইনিভাবে বিক্রি করা হচ্ছে পুরনো ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে। নিয়ম অনুযায়ী নারকোটিক্স ও বিস্ফোরক অধিদফতর থেকে ছাড়পত্রধারীদেরই কেবল কেমিক্যাল বিক্রি করার কথা। কিন্তু পুরনো ঢাকার কেমিক্যাল বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের বেশিরভাগেরই সে ছাড়পত্র নেই।
গত বুধবার পুরনো ঢাকার বিভিন্ন গলি ঘুরে দেখা গেছে সেই পুরনো চিত্র। রাস্তার ওপর কেমিক্যালের ড্রাম রেখে মানুষের চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। উপরে মানুষের বসবাস আর নিচে কেমিক্যাল গোডাউন। ঠেলাগাড়ি, ভ্যানে করে নেয়া হচ্ছে কেমিক্যালের ড্রাম। পাশ দিয়েই চলাচল করছে সাধারণ মানুষ। শুধু আগুন নয়, এসব বিষাক্ত কেমিক্যাল একটু ছিটে শরীরে লাগলে পুড়ে যেতে পারে, বড় ধরনের অসুখ-বিসুখে পড়তে হতে পারে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই কারো। ২০১০ সালের নিমতলী ট্রাজেডির পর পুরনো ঢাকায় কদমতলীর শ্যামপুর শিল্প এলাকায় একটি কারখানায় ছাদের থাকার ঘরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আটজন শ্রমিক ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যান। এছাড়া ছোটখাটো আগুন নিয়মিত লাগছেই। ২০১১ সালের ২০ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে ঢাকা মহানগরের আবাসিক এলাকা থেকে অবৈধ রাসায়নিক কারখানা ও গুদামগুলো কামরাঙ্গীরচর ও কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এজন্য বিসিকের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে একটি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবকে প্রধান করে আরেকটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কমিটিগুলো এখনও কাজই শুরু করতে পারেনি। [Adverts]
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান ‘ইত্তেফাক’কে বলেন, মানুষের সচেতনতার অভাবে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। যেসব ভবনে বা কারখানায় আগুন লাগছে সেগুলোর অধিকাংশেই অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই। আবার কোথাও আগুন লাগলে সাধারণ মানুষ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতা করার পরিবর্তে রাস্তা আটকে উত্সুকভাবে তাকিয়ে থাকে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে ভবন বা কারখানা মালিকদের আরো বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল কারখানা সরিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দ্রুত এ কাজটি না করা গেলে আরো ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি বলেন, ‘পুরনো ঢাকার সরু গলির জন্য বাধ্য হয়ে আমরা ছোট পানির গাড়ি কিনেছি।’
দমকল বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী পুরনো ঢাকায় কেমিক্যাল কারখানা থেকে গত ১৫ বছরে দু’শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। দেশে কতগুলো কেমিক্যাল কারখানা রয়েছে, সেই কারখানার কতোগুলো আবাসিক এলাকায়, কতোগুলো সরকারি নিয়ম-নীতি মেনে গড়ে উঠেছে আর এর বাইরে যত্রতত্র কতোগুলো কেমিক্যাল কারখানা আছে তার কোনো হিসাব নেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে। নিমতলীর নবাব কাটারায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে অননুমোদিত কেমিক্যাল গুদামকে দায়ী করা হলেও কতজন এধরনের কেমিক্যাল আমদানিকারক রয়েছেন তারও কোন হিসাব দিতে পারেননি কেউ। বৈধতা ছাড়াই দেদারসে চলছে বিপজ্জনক এই ব্যবসা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের কাছেও কেমিক্যাল কারখানা ও কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের তালিকা নেই। তবে এখন থেকে এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় না থাকার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নিমতলীর পর ওই এলাকায় কয়েকদিন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। সে সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়ে ১০৪টি মামলা করে ৩৫ লাখ ১৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে। সেই শেষ, আর কোন খবর নেই।
নিমতলীর নবাব কাটারায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার মধ্যদিয়ে নিরাপত্তাহীনতার করুণ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সরু রাস্তার কারণে অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। নিজের ঘরেও যে মানুষের জীবন নিরাপদ নয় সেটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে জানান দিয়েছে নিমতলী ট্র্যাজেডি। শিল্প, বাণিজ্য আর বসতি— এই তিনের মধ্যে বেঁচে আছে পুরনো ঢাকাবাসী।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘নিমতলী ট্র্যাজেডির পর ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে অনেক কেমিক্যালের গোডাউন উচ্ছেদ করা হয়েছিল। এখন আবার চলে এসেছে। এখন যেহেতু নগরে নতুন মেয়র এসেছেন তাই এই পরিস্থিতিতে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, দু’একদিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে মেয়রকে অবহিত করব। সিটি কর্পোরেশনে ভ্রাম্যমাণ আদালত আছে। তারা এখন থেকে বিষয়টি নিয়মিত দেখভাল করবে।’