ব্রেকিং নিউজ
Home / প্রচ্ছদ / মাঠের সঙ্গে হিসাব মিলছে না ইসির তথ্যের

মাঠের সঙ্গে হিসাব মিলছে না ইসির তথ্যের

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মাঠের হিসেব মিলছে না। ইসির দেওয়া তথ্যমতে, মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর, দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গড়ে ৪৪ শতাংশ (৪৩.৯৭) ভোট পড়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। দক্ষিণে ভোট প্রয়োগের হার ৪৮.৫৭ শতাংশ। কিন্তু, সরেজমিনে ভোট কেন্দ্রগুলোর অবস্থা বিবেচনায় নিলে নির্বাচন কমিশনের এ হিসাবের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডের মোট ভোট কেন্দ্র ১৩টি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলে ১৩টি কেন্দ্রের মোট ভোটার সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৪৩ জন। এর মধ্যে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে ১৬ হাজার ৭৪৯ জনের। অর্থাৎ প্রায় ৬৫ শতাংশ (৬৪.৫৬) ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।
ওই ওয়ার্ডের (৪১ নম্বর) দক্ষিণ মুহসেন্দী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মোট তিনটি ভোট কেন্দ্র ছিল। এ তিন কেন্দ্রের মধ্যে পুরুষ ও নারী মিলে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ভোটার রয়েছেন। এর মধ্যে তিন নম্বর কেন্দ্রটি মহিলা ভোট কেন্দ্র।
ভোটগ্রহণের দিন মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বালিকা বিদ্যালয়টির ৩ নম্বর কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বুথে বুথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী সাঈদ খোকনের ইলিশ প্রতীকের পাশাপাশি কাউন্সিলর প্রার্থীর কয়েকজন পোলিং এজেন্ট বসে আছেন। তবে সেখানে বিএনপি সমর্থিত মির্জা আব্বাসের মগ মার্কার কোনো এজেন্ট দেখা যায়নি। পুরো কেন্দ্র জুড়ে শুধু দুজন ভোটারকে দেখা গেছে। প্রায় একই অবস্থা ছিল বাকি দুটি কেন্দ্রে। ওই কেন্দ্র দুটিতে ১০-১৫ জন করে ভোটার দেখা গেছে।
তবে ভোটার দেখা না গেলেও বিপুল সংখ্যক যুবককে ইলিশ প্রতীকের বুকলেট বুকে নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরে দেখা গেছে। ছিলেন পর্যাপ্ত আনসার ও পুলিশ সদস্যও।
৪১ নম্বর ওয়ার্ডের মধ্যে আরও দুটি কেন্দ্র কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজে। এর মধ্যে ১ নম্বর কেন্দ্রটি পুরুষ (ভোটার দুই হাজার ৩২৮জন) ও ২ নম্বরটি মহিলা (ভোটার দুই হাজার ১৬১জন) ভোট কেন্দ্র।
সকালে কিছুক্ষণ ভোটগ্রহণ শুরুর পরেই সরকার সমর্থক দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে জাল ভোট দেওয়াকে নিয়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর এক পর্যায়ে ভোট কেন্দ্র দুটির ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়।
দুপুর একটার দিকে কবি নজরুল সরকারি কলেজ কেন্দ্রের (২ নম্বর) প্রিসাইডিং কর্মকর্তা কাজী মো. সানাউল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বেলা সোয়া ১১টা থেকে ভোট গ্রহণ বন্ধ রেখেছি। পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকবে।’ এ কেন্দ্রে ২ হাজার ১৬১ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৫০০ ভোট গ্রহণ করা হয়েছে বলে তখন তিনি জানান।

image
ঢাকা দক্ষিণের এমন চিত্র ছিল বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্রে। সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত দক্ষিণের ২ নম্বর ওয়ার্ডের শান্তিপুর কলেজের দুই কেন্দ্রে ভোটগ্রহণই শুরু করতে পারেননি প্রিসাইডিং কর্মকর্তা।
সরেজমিনে কেন্দ্র দুটিতে গিয়ে দেখা যায়, সকাল ৮টার কিছু আগে সরকার সমর্থক ও বিএনপি সমর্থক মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্টদের বেশিরভাগই ভোট কেন্দ্রের ভেতরে প্রবেশ করে। ১৫-২০ জন মহিলা ভোটারকে লাইনে দাঁড়িয়েও থাকতে দেখা যায়। তবে সরকার সমর্থক কাউন্সিলর প্রার্থীর কর্মীদের হুমকি ধামকিতে এক পর্যায় সোয়া ৮টার দিকে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের (মেয়র-কাউন্সিলর) পোলিং এজেন্টদের কৌশলে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় নিরব দর্শকের ভূমিকায় দেখা যায় পুলিশকে। এরই মধ্যে ভোটারদের আনাগোনা না বাড়লেও ভোট কেন্দ্র্রের ভেতরে ও বাইরের রাস্তায় আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের কর্মীদের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। অর্থাৎ ভোটারের চাইতে সরকার সমর্থক প্রার্থীর কর্মীদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সাড়ে ৮টার মধ্যে ভোটগ্রহণ শুরু করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। ২ নম্বর ওয়ার্ডের বেশিরভাগ কেন্দ্রেই এমন দৃশ্য ছিল বলে সরেজমিনে খোঁজ খবরে জানতে পারেন। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে এই ওয়ার্ডে ৪৭ শতাংশেরও বেশি ভোট প্রয়োগ হয়েছে।
সকাল ৮টায় ভোট গ্রহণের আধা ঘণ্টার মধ্যেই দক্ষিণের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের খিলগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায় অনানুষ্ঠানিকভাবে। কারণ ওই কেন্দ্রের ৫ ও ৬ নম্বর বুথের ব্যালট পেপারই সরকার সমর্থকরা সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। সকাল ১০টার পর আবারও ভোটগ্রহণ শুরু হয়। ভোটারের সংখ্যা ৬০-৭০ জনের বেশি দেখা যায়নি। তবে ভোটগ্রহণ বন্ধ থাকলেও সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওই কেন্দ্রের ৩ নম্বর বুথে জাল ভোট দিতে দেখা যায় কয়েকজনকে। যার ছবি ক্যামেরায় ধরা পড়ে।
নির্বাচন কমিশন বলছে, ১১ নম্বর ওযার্ডের ১৫টি কেন্দ্র মিলে দিনশেষে প্রায় ৩৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। শুধু যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এমন চিত্র ছিল তা নয়। অন্য দুই সিটিতেও ছিল একই অবস্থা।
২৮ এপ্রিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কিশলয় বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের শুরু থেকেই সাংবাদিকদের প্রবেশে বাঁধা ছিল অন্যান্য কেন্দ্রের মতই। সকাল থেকেই ভোট কেন্দ্রের বাইরে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের স্বেচ্ছাসেবক ও সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতি দেখা গেলেও ভেতরের চিত্র ছিল ভিন্ন। প্রতি দশ মিনিটে মাত্র একজন ভোটার মূল ফটক দিয়ে কেন্দ্রের ভেতরে প্রবশে করেছেন। ভেতরে ছিল না ভোটারদের দীর্ঘ লাইন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে উত্তর সিটি করপোরশনের জাসদ সমর্থিত মেয়র প্রার্থী অভিনেতা নাদের চৌধুরী তার সহধর্মীনিকে নিয়ে ভোট দিতে আসেন। চার তলা ভবনের প্রতিটি তলায় ছিল আলাদা আলাদা বুথ। তিন তলায় পুরুষদরে একটি বুথে সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে ভোট দেন নাদের চৌধুরী। তখন ওই বুথে মোট ২৬৫ জন ভোটারের মধ্যে মাত্র ১২ জন ভোট দিয়েছেন। এরপর খোঁজ নেওয়া হয় দ্বিতীয় তলায় অবস্থতি নারী বুথে। তখনও মোট ৩২৫ জন মহিলা ভোটারের মধ্যে একজনেরও ভোট পড়েনি।
দুপুর ২টার দিকে ২৯ নম্বর ওর্য়ার্ডের কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে জানা যায়, ৩২৫ নারী ভোটাররে মধ্যে মাত্র ১৮ জন জন তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। প্রায় একই চিত্র ছিল ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাকি কেন্দ্রসহ অন্যান্য ওয়ার্ডেও।
অথচ ভোটগ্রহণ শেষে জানা গেল, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোট ১৬টি কেন্দ্রে প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। আর উত্তরের সব কেন্দ্র মিলে ভোট প্রয়োগের হার গড়ে ৩৭ শতাংশেরও বেশি।
সরেজমিনে প্রতিবেদকদের তথ্যানুসন্ধান এবং বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়,

মঙ্গলবারর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে জাল ভোট, ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ তুলে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। তারা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের (মেয়র-কাউন্সিলর) প্রতীকে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে সিল মারেন নির্বাচনী এজেন্ট ও দলীয় কর্মীরা।
নির্বাচনের দিন ভোট কারচুপি তথা জাল ভোট প্রয়োগে পুলিশও সরকার সমর্থিতদের সহযোগীতা করে কোথাও কোথাও। আর নির্বাচনী কাজে প্রধান দায়িত্ব যাদের সেই প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারদের বেশিরভাগকেই অসহায়ের ভূমিকায় দেখা গেছে এদিন।
এদিকে সিটি নির্বাচনকে একটি তামাশার আবর্জনা ও বর্জ্য হিসেবে এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে তা বাতিল, পুনর্নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ দাবি করেছে বিশিষ্ট নাগরিকদের সংগঠন ‘আদর্শ ঢাকা আন্দোলন’।
জাতীয় প্রেস ক্লাবে বুধবার বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করেন সংগঠনের আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ।
সিটি নির্বাচনে অনিয়ম নিয়ে বিএনপিপন্থী আদর্শ ঢাকা আন্দোলনের পাশাপাশি বুধবার এক বিবৃতিতে টিআইবিও এ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ বলে অভিহিত করেছে। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এক বিবৃতিতে বলেন, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও পেশীশক্তির প্রয়োগে ব্যাপক অনিয়ম সংঘটিত হওয়ায় সদ্যসমাপ্ত তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচন কমিশনের মতো সাংবিধানিক একটি প্রতিষ্ঠানের নির্বাচনী আইন-প্রয়োগসহ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা হওয়ায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।’
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘ব্যাপক কারচুপির নির্ভরযোগ্য তথ্য আর প্রমাণ থাকার পরও কমিশন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অস্বীকৃতি, মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়ে নিজেকে বিব্রত করেছে। যথাযথ দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন শুধু যে ব্যর্থ হয়েছে তাই নয়, বরং কমিশন ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক আচরণ করায় সাংবিধানিক এই প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তি ও জন-আস্থা ধূলিসাৎ হয়েছে।’
শুধু দেশের সুশীল সমাজ নয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিদেশী অনেক সংস্থা ও ব্যক্তির পক্ষ থেকেই সিটি নির্বাচনে কারচুপির বিষয়টি নিয়ে কথা তুলেছেন।
তবে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি করছে আওযামী লীগ।
তিন সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কারচুপি হলে এত ভোট পেত না বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।’ বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এ কথা বলেন তিনি।
বিএনপি শাসনামলে মাগুরাসহ কয়েকটি নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগের নির্বাচনের চেয়ে এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’
এ সময় বিএনপিকে ‘কুৎসিত সংগঠন’ হিসেবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সিটি নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামবাসী তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এ জন্যই নিজেরা পাল্টি খেয়েছে।’
এর আগে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ বলেছেন, ‘বিছিন্ন কিছু ঘটনার মধ্য দিয়ে ঢাকা উত্তর-দক্ষিণ ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে।’
ঢাকা সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন।