ফারহানা কামাল, লন্ডন :: পৃথিবীতে সব সন্তানই তা মানবই হোক আর জীবের সেই সন্তান যেন ঘরকে আলোকিত করে পৃথিবীতে তার আগমনের বার্তা জানায় ! আমার আব্বা-আম্মার ঘর আলো করে ৪২ বছর আগে আষটে পুতুল পুতুল একটা মেয়ের জন্ম হয় ! ছেলের পরে মেয়ে আর সময়ের আগেই অপরিপক্ক এই সন্তানকে পেয়ে বাবা-মায়ের খুশির অন্ত ছিল না ! তার প্রতি স্বাভাবিক ভাবেই অতিরিক্ত যত্ন আর ভালবাসার প্রয়োজন হয় ! এরমাঝে শারীরিক ভাবে প্রায়ই এই পুতুল মেয়েটি নানা অসুখে ভোগে ! একের পর এক চেষ্টা চলতেই থাকে এই পিতা-মাতার ! যা কিনা আমি আব্বা-আম্মার কাছে শুনেছি ! কিছু সময় পরে এই সন্তানটি পরিপূর্ণ সুস্থ ভাবে বেড়ে উঠে ! শিশু, কিশোরী, যুবতী..এই ভাবে সেই পুতুল মেয়েটা বড় হতে থাকে তার অন্যান্য ভাই- বোনদের সাথে !
সৃষ্টিকর্তা আমাকে সেই পুতুল পুতুল মেয়েটার একমাত্র ছোট বোন হিসেবে দুনিয়াতে পাঠান ! আদর করে আমি সহ আমার বাকি দুই ভাই ডাকতাম ‘আপুনি’ ! প্রচন্ড মেধাবী আমার বোনটিকে কখনো ক্লাস এ দ্বিতীয় হতে দেখিনি, এক চান্স এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মত মেধাবী ছাত্রী আমার আপুনি ! বরাবরই প্রথম হয়ে বাবা মার মুখ উজ্জল করেছে আমার লক্ষী গুনি বোনটি ! রেজাল্ট ভালো করে বাবা-মাকে গর্বিত করার সৌভাগ্য আমার হয়নি বটে কিন্তু আপুনি সহ অন্য ভাইদের জন্য বেশ ভালই বড়াই করে বেড়াতাম, আলহামদুল্লিলাহ ! আমার বাবার বাড়ির অনেক শিল্প,কারুকার্যে তার হাতের সুনিপুন ছোঁয়া আজও বিদ্যমান !
৯২ সনে আব্বা-আম্মা তাদের পছন্দ করা ছেলের হাতে সারা জীবনের জন্য তুলে দেন ‘বিবাহ’ নামক এক সম্পর্কের কারণে ! আল্লাহর হুকুম মোতাবিক আমরা সবাই তাকে তার নতুন সংসার আর পরিবারের সাথে মিলে মিশে যেতে দেখে বড় শান্তি পেতাম ! যদিও নিজের ঘরে, স্বামী নিজ সংসারে যেতে সুদুর আমেরিকাতে কয়েকটা বছর লেগে যায় ! তারপর সেই খানে এই অসম্ভব মাতৃত্ব সম্পন্ন আমার লক্ষী বোনটির কোল জুড়ে ঘর আলো করে একে একে (দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে) তিনটি সন্তানের জন্ম হয় ! বিদেশ বিভুইয়ে তিনটি সন্তান লালন পালন করা চারটি খানি কথা নয়, এরমাঝে প্রায় শত বছর বয়সী শাশুড়ি ! দিনের পর দিন এইভাবে সবাইকে অকৃপণ ভালবাসা, সেবা, দিয়ে পনরটি বছর এই কঠিন পথ পাড়ি দিতে দিতে আমার বোনটি একসময় কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে পরে ! আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সকল সুশিক্ষার পরে আমার পিতামাতার দেয়া সবচেয়ে বড় শিক্ষা, “কাওকে কখনো কোনভাবে কষ্ট দিও না” … তাই বোধ হয় কাওকে কোনো কষ্ট দেইনি আমার আপুনি ! বড় সংক্ষিপ্ত সময়ে চলে গেল এমন একটা আলোকিত মেয়ে ! যে কিনা সন্তানদের, পরিবার সহ অন্যদের জীবনে শুধু আলোই জ্বেলে গিয়েছে !
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যখন যেই অবস্থায় রাখেন না কেন আমরা শোকর করে থাকার চেষ্টা করি, এত শোকর গুজারী আমার প্রিয় আপুনি মৃত্যুর পূর্ববর্তী দিন গুলোতেও যখন ফোনে সালাম দিয়ে জিগ্যেস করতাম একটি বারের জন্য বলতে শুনিনি যে, ‘আমি ভালো নেই, অনেক কষ্ট’ এই জাতীয় কোনো কথা !
“আলহামদুল্লিলাহ, আমি ভালো আছি ! ”
এমনকি দুনিয়াতে তার জীবনের শেষ দিনটিতেও ! তার মুখের এই কথা গুলো শুনে নিজেকে আর সামাল দিতে পারি নাই ! ফোন রেখেই নামাজে দাড়িয়ে যাই ! জায়নামাজে বসে সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু এইটাই বলেছি, ‘দেখো মাবুদ দেহে এত কষ্ট ব্যথা বয়েও তোমার বান্দার কত শোকর !’
আমার মেয়ে দুটো তাদের একমাত্র খালামনির সাথে শেষ কথা যখন বলে, শরীরে এত কষ্ট নিয়েও খালামনি হিসেবে শেষ তিনটি কথা বলেছে, ‘ভালোভাবে পড়াশোনা করো, মা-বাবাকে কোনো কষ্ট দিও না আর আমার জন্য দুয়া করো !’ প্রায়ই আমার মেয়েগুলো খালামনির এই কথা গুলো স্মরণ করে কাঁদতে থাকে ! আর আমার ছেলেটি খালামনি কি তার কত আদর তা বোঝার মত বয়স পার করবার আগেই খালামনিকে হারিয়ে ফেলেছে !
পৃথিবীতে ছোট ছোট সন্তানদের ছেড়ে যাওয়ার কষ্টটা যে কত অসীম অসহনীয় তা হয়ত মা হিসেবে বুঝতে পারি ! স্কুল ব্যতিত এক ঘন্টার জন্য কেন দশ মিনিট ও চোখের আড়াল করতে চাই না ! সেখানে একটা মায়ের জন্য কতখানি বেদনাদায়ক তা হয়ত এমন কয়েক হাজার লাইন, শত বই লিখেও বর্ণনা দেয়া সম্ভব নয় ! ঠিক অনুরূপ মাকে হারানোর নির্মম কষ্ট ! কাগজে কিংবা বইয়ে পড়েছি, পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে হতভাগ্য যার মা নেই ! আবার এমন ও পড়েছি, পৃথিবীতে সেই সবচেয়ে ধনী যার মা আছে !
নারী ছেড়া তার অমুল্য ধন তিনটি সন্তানকে ছেড়ে যাবার দিন সন্তানকে দেয়া শেষ উপদেশ,” ১) ভালোভাবে পড়াশোনা করো, ২) কাওকে কোনদিন কষ্ট দিও না, ৩) অনেক সময় মা হিসেবে তোমাদের মঙ্গলের জন্য হয়ত রাগের কারণে বেশি শাসন করেছি, সেই জন্য মায়ের প্রতি কোনো রাগ রেখো না, মাকে ক্ষমা করে দিও !
এবার বলি আমার সাথে আমার প্রানপ্রিয় আপুনির প্রানের কিছু কথা ! আমি যখন বরাবরের মত আমার মেধাবী অপরুপা আপুনির নানা গুনের কথা গুলো ফোনে বলছিলাম তখন অনুভব করতে পারছিলাম ফোনের দুই প্রান্তে ক্রন্দনরত দুই বোন জীবনের শেষ গল্প করছে ! কিছুক্ষণ শোনার পর আমাকে থামিয়ে দিয়ে আপুনি বলল, ‘তুমি আমার কথা বল এবার আমি বলি তোমার কথা, তুমি সহ তোমরা সবাই গর্ব করো আমাকে নিয়ে আমিও যে তোমাকে নিয়ে গর্ব করি, আমরাও যে তোমার মত এমন ব্রিলিয়ান্ট মায়াবতী বোনকে নিয়ে গর্ব করি, আল্লাহ যাকে এত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন আর তোমাকে বড় পবিত্র একটা আত্মা দিয়েছেন’…আর বলতে পারব না আমার বোনের শেষ কথা গুলো ! এই পর্যন্তই থাকুক !
যার সাথে আমার ২১ টা বছর একই বিছানায় ঘুম, ছোট বেলার আমার আদর, ভালবাসা, ঝগড়া খুনসুটি সেই প্রিয় মানুষটির মৃত্যুর খবর পেয়ে জীবনের শেষ দেখা আর শেষ আদর করতে ছুটে যাই আমেরিকাতে ! যাবার পর তার শশুর কুলের কাছের, দুরের আত্মীয়, প্রতিবেশী সকলের একান্ত ভালবাসা দেখেছি ! দেখেছি তাদের অশ্রু সজল নিরব দুটি চোখ, তাদের মুখে শুনেছি আমার বোনের নানা গুনের কথা ! স্মৃতি চারণ করতে করতে অনেককে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে দেখেছি ! শুনেছি তার সুন্দর পবিত্র মৃত্যুর মুহূর্ত গুলোর কথা ! আমার কান্নার চিত্কারে অনেককেই সান্তনা দিতে শুনেছি, ‘আপনি কাঁদছেন কেন আপু ?আপনার বোনতো জান্নাতি ! আপনার বোন সকল কালিমা পড়ে, আয়াতুল কুরসী পড়ে, সুরাহ ফাতিহা পড়ে অন্যান্য সুরাহ পড়তে পড়তে চোখ বন্ধ করে ডান দিকে কাঁত হয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন..ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন ! এমন সুন্দর মৃত্যু কজনের হয় ?’– হাদিসেই পড়েছি ‘যার শেষ বাক্য হবে কালিমা, আল্লাহর নাম থাকবে সে জান্নাতে যাবে’ ! ইনশাল্লাহ আল্লাহ আমার আপুনির সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিবেন, তার ছেলে মেয়ে গুলোকে তাঁর ছায়া তলে রাখবেন, আর আপুনিকে জান্নাতে অধিষ্ঠিত করবেন- আমীন !
আমরা কেও পৃথিবীতে চির কাল থাকব না ! একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের সকলের সেই একই ডেস্টিনেশন আমরা সবাই জানি, শুধু এই যাওয়াটা আগে আর পিছে ! আল্লাহ যাকে বেশি ভালবাসেন তাকে এই পাপী দুনিয়াতে রাখতে চান না ! আর এই দুঃক্ষ ভরা কিংবা সুখে ভরা আমাদের সবার জীবন ! এর থেকে কারো নিস্তার নেই ! ঘুরে ফিরে সবার জীবনেই আসবে তা নিশ্চিত ! সব জেনে বুঝেও এই অবুঝ মনকে বোঝাতে কষ্ট হয় যে আমার আপুনি নেই ! এখনো প্রায়ই মনের অজান্তে আপুনিকে কল দিয়ে ফেলি ! মনের অজান্তেই স্বপ্ন দেখতে থাকি আপুনি আবার আসবে ইংল্যান্ড এ বেড়াতে আসবে আমাদের কাছে ! এমন কোনো বেলা বা ক্ষণ যায় না এই প্রিয় মানুষটির কথা মনে করে কাঁদি না ! এইভাবে দিন পার করে চলেছে সন্তানহারা আমার আব্বা- আম্মা, বোন হারা আমরা ভাই-বোনেরা ! কত শত কোটি স্মৃতি চারণ করতে থাকি কাজে কিংবা অকাজে ! এত কষ্ট এত কষ্ট যে এটা বইবার মত বুকের ভেতরে আর বুঝি জায়গা নেই ! তারপর ও এটাও জানি সারা জীবন এই দুঃক্ষকে বয়ে বেড়াতে হবে !