উত্তরার বাসা থেকে অপহরণের পর এক রুমে ৬১ দিন কেটেছে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের। তবে ১০ই মে রাতের খাবারের কিছুক্ষণ পর নতুন করে তার হাত-চোখ বেঁধে ফেললে ওই রাতকেই শেষরাত মনে করেন তিনি। শিলং সিভিল হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন সালাহউদ্দিন আহমেদ তার সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া ঘনিষ্ঠজন এবং গোয়েন্দাদের এ তথ্য জানান। তিনি বলেছেন, রাতের খাবারের পর যখন আমার হাত ও চোখ বাঁধা হয় তখন ভেবেছিলাম মেরে ফেলার জন্য ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাই ভয়ে আমার হাত-পা শীতল হয়ে আসে। বারবার স্ত্রী-সন্তান, এলাকাবাসীসহ দেশের মানুষের কথা মনে করতে থাকি। এর বেশি কিছু চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। এদিকে, সোমবার আটকের পর মানসিক হাসপাতালে নেয়ার আগে পুলিশ সালাহউদ্দিন আহমেদের দাড়ি শেভ করার ব্যবস্থা করে। তার সঙ্গে দেখা করে এসে বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি এ তথ্য জানান। ৬১ দিন সালাহউদ্দিন আহমেদ কী অবস্থায় ছিলেন জানতে চাইলে জনি বলেন, এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে তার মুখে জড়তা চলে আসে। ক্লিয়ারভাবে কিছু বলতে পারছিলেন না। আর এসব বিষয়ে কথা বলার সময় এখন নয়। আমি মনে করি, সালাহউদ্দিনের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত। এ বিষয়টি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকলে আমাদের জন্য মঙ্গল।
যেভাবে আটকের পর ৬১ দিন এক রুমে:
১০ই মার্চ উত্তরা থেকে আটকের দুই ঘণ্টা পর একটি ঘুপচি রুমে নিয়ে তাকে রাখা হয়। এরপরই চোখের বাঁধন খুলে ফেলা হয়। মেঘালয় রাজ্যের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছেও সালাহউদ্দিন বন্দি থাকা রুমের বর্ণনা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন তার এক আত্মীয়। ওই বর্ণনায় বলা হয়েছে, সালাহউদ্দিনকে উত্তরার বন্ধুর বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়। চোখ ও হাত বেঁধে নিয়ে যাওয়ার আগে ওই ভবনে বসবাসকারী সালাহউদ্দিনের বন্ধু হাবিব হাসনাতসহ কাজের লোকদেরও চোখ বেঁধে ফেলা হয়। তুলে নিয়ে যাওয়ার দুই ঘণ্টা পর একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। ওই কক্ষে টয়লেট, ফ্যান, দরজা ও ভেন্টিলেটর ছাড়া কিছুই ছিল না। নিয়মিত তাকে তিন বেলা খাবার দেয়া হতো। পাশাপাশি দেয়া হতো হার্টের ওষুধ। তিনি যেসব ওষুধ খেতেন তা জানানোর পর নিয়মিত কিনে দেয়া হতো। এভাবেই দিন গুনতে থাকেন তিনি। সালাহউদ্দিন গোয়েন্দা ও ঘনিষ্ঠজনদের কাছে বলেছেন, প্রতিদিন আল্লাহকে ডেকে সময় পার করতেন। তিনি বলেন, দিনের আলো দেখতে পাইনি। তবে মাঝে মধ্যে প্লেনের বিকট শব্দ শুনেছি। এ শব্দটা খুব জোরে হতো। মারধর করেছে কিনা এমন প্রশ্নে কিছুক্ষণ চুপ থেকে সালাহউদ্দিন জানান, আমার সঙ্গে ওরা খুব ভাল ব্যবহার করেছে। তিন বেলা ঠিকমতো খেতে দিয়েছে। ওষুধ দিয়েছে। কোন ধরনের টর্চার করেনি। কোথায় আটক ছিলেন এমন প্রশ্নে ঘুরেফিরে বলেছেন, আমার চোখ ও হাত বাঁধা ছিল। তাই স্থান নিশ্চিত করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাছাড়া আটকের পর থেকে একটি রুমেই ছিলাম। কোথায় ছিলাম সেটা বলতে পারবো না। এটুকু বলতে পারবো একটি বদ্ধ রুমে আটক ছিলাম।
নিজের রাজনীতি ও পারিবারিক ইতিহাস:
সিভিল সার্ভিসের চাকরি ছেড়ে কিভাবে রাজনীতিতে এলেন, কি মন্ত্রী ছিলেন, কতবার এমপি হয়েছিলেন- গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসায় এসবের জবাব দিয়েছেন সালাহউদ্দিন আহমদ। নিজের রাজনীতি নিয়ে জবাব দেয়ার পাশাপাশি স্ত্রী হাসিনা আহমেদ ছিলেন সাবেক এমপি- এ কথাটিও বলেছেন তিনি। এছাড়া তার এক ছেলে ও এক মেয়ে বিদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে তাও জানান। এসব বিষয়ে কথা বলার ফাঁকে মাঝে মধ্যে আবেগতাড়িত হয়ে যান। এছাড়া সরকারি চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে কেন জড়ালেন ওই বিষয়টিও বলেন সালাহউদ্দিন।
বন্ধু ব্যাংকার হাবিব হাসনাতের কাছে ঋণী:
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের উপ- ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাবিব হাসনাতের ফ্ল্যাটেই থাকতেন সালাহউদ্দিন। আটক করার আগে হাবিব হাসনাতের চোখ ও হাত বেঁধে ফেলা হয়। ওই ব্যাংকার সম্পর্কে সালাহউদ্দিন বলেছেন, আমি আমার বন্ধু হাসনাতের কাছে ঋণী। তিনি ওই সময় সাহসিকতার সঙ্গে আমাকে রেখেছেন। এখন শুনছি হাবিব হাসনাতই আমার স্ত্রীকে দুবাই থেকে ফোন করে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবরটি দিয়েছে। এখন জেনেছি, ও (হাবিব হাসনাত) দেশ ছেড়ে এখন সপরিবারে আমেরিকা থাকছে। ওর জন্য কষ্ট লাগে। আমার জন্য হাবিব হাসনাতকে পরিবার নিয়ে দেশের বাইরে থাকতে হচ্ছে।
শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, সিঙ্গাপুর যেতে চান:
মেঘালয়ের সিভিল হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। গতকাল বেলা ১১টায় বিএনপির সহ-সম্পাদক আবদুল লতিফ জনি বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য শিলংয়ের সিভিল হাসপাতালে আসেন। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন মেঘালয় রাজ্যের ডাউকিতে বসবাসকারী স্ট্যালিন ও লাজবন। জনি দুই কেজি আপেল, কয়েকটি লেবু ও ইসবগুলের ভুসি নিয়ে দেখা করতে প্রিজন সেলে যান। বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদকের হাতে আপেল দেখে সালাহউদ্দিন বলে উঠেন, আমার জন্য এত খাবার নিয়ে আসছ কেন? আমি তো খেতে পারছি না। হাসপাতালের খাবার দেখিয়ে বলেন, এই যে দেখো কত খাবার দিয়ে গেছে। এত খাবার কিভাবে খাবো। লতিফ জনি এসব কথা শুনে ইসবগুলের ভুসি নিয়ে ডাক্তারের উদ্দেশ্যে দৌড় দেন। কিন্তু ডাক্তারের বিধি নিষেধের কারণে ইসবগুলের ভুসি দিতে পারেননি। বাইরে বেরিয়ে আবদুল লতিফ জনি সাংবাদিকদের জানান, সালাহউদ্দিন আহমেদের শারীরিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তিনি অসুস্থ বোধ করছেন। সকাল পর্যন্ত তার পায়খানা ক্লিয়ার হয়নি। তার মানসিক অবস্থা আগের মতোই আছে। আমার মনে হয়, তার স্ত্রী ভারতে আসার পর তাকে দেখলে হয়তো মানসিক অবস্থার উন্নতি হতে পারে। তিনি বলেন, সালাহউদ্দিন সাহেব আমাকে বলেছেন তার অসম্ভব ব্যাক পেইন শুরু হয়েছে। ব্যাক পেইনসহ নানা সমস্যার কারণে গতকাল রাতেও তিনি ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেননি। আমি মনে করি, উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া উচিত। কোন দেশে নিয়ে তাকে চিকিৎসা করানো যেতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল লতিফ জনি বলেন, সালাহউদ্দিন আহমেদ ইতিপূর্বে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ওই দেশের ডাক্তারদের ট্রিটমেন্টে আছেন। চিকিৎসার বিষয়ে তার স্ত্রী শিলংয়ে আসার পর ভারতীয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমরা আশা করবো কর্তৃপক্ষ যেটা ভাল মনে করবে সেটাই করবেন। ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলার কাগজ পেয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে সহ-দপ্তর সম্পাদক জনি বলেন, মামলার কাগজপত্র উঠানোর জন্য আমি যাইনি। এসব কাগজপত্র উঠানোর কাজটি লিগ্যাল প্রসেস। তার জন্য যে আইনজীবী নিয়োগ করা হবে তিনিই এসব কাগজপত্র উঠানোর কাজটি করবেন। সালাহউদ্দিনের স্ত্রী আসার পর এ বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে। সিভিল হাসপাতালের ডাক্তারদের চিকিৎসা নিয়ে সন্তুষ্ট কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের ট্রিটমেন্ট স্ট্রাকচার ও এ হাসপাতালের ট্রিটমেন্ট স্ট্রাকচার এক নয়। এখানের ডাক্তাররা চিকিৎসা করছেন। কিন্তু স্পেশালাইজড ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসার যে ব্যবস্থা সেটা হয়তো এখানে তিনি পাচ্ছেন না। এজন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে চিকিৎসা করানো দরকার বলে মনে করছেন তিনি। এদিকে গতকালও চিকিৎসকরা সালাহউদ্দিন আহমেদের স্বাস্থ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তাকে দেখে এসে কার্ডিওলজিস্ট ডা. জি. গোস্বামী বলেন, আমরা তার সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি। সালাহউদ্দিনের ওজন কমে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, আগে তার ওজন কত ছিল তা আমরা জানি না। তাই এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছি না।
ভাতিজা করিমকে পেয়ে আপ্লুত:
অনেক দিন পর রক্তের সম্পর্কের কাউকে কাছে পান বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন। কাছে পেয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, দুপুর একটায় পুলিশি অনুমতি নিয়ে চাচার সঙ্গে দেখা করতে যান মো. করিম। এ সময় প্রিজন সেলের ভেতরে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। চাচা-ভাতিজা দুজনেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেন। বাইরে বেরিয়ে মো. করিম বলেন, অনেক দিন পর রক্তের সম্পর্ক কাউকে দেখে আপ্লুত হয়ে যান চাচা। নিজের এলাকায় গরিব-দুখী ও যেসব ছাত্রছাত্রীকে মাসিক সহায়তা দিতেন তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। বাড়ির সবাই কেমন আছে ওই বিষয়টিও জানতে চান। চাচা এলাকাবাসীসহ আত্মীয়স্বজন সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। এদিকে গতকালও কলকাতা থেকে আসা আইয়ুব আলী সালাহউদ্দিনের দেখভালে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বলেন, ভাবি হয়তো সোমবার চলে আসবে। এরপর নিজের কাজে যাবো। এর আগে যাচ্ছি না।
সালাহউদ্দিনকে পেয়ে খুশি ইউটিপি সেলের ৭ বন্দি :
সালাহউদ্দিন আহমেদকে পেয়ে খুশি আন্ডার ট্রায়াল প্রিজনার (ইউটিপি) সেলের অন্য ৭ বন্দি। এর মধ্যে পাঁচজন পুরুষ ও দুইজন মহিলা বন্দি। সালাহউদ্দিনকে দেখভাল করেন এমন নার্সসূত্রে জানা গেছে, নিজের জন্য বাইরে থেকে যেসব খাবার সালাহউদ্দিনের কাছে যাচ্ছে তার বেশির ভাগ নিজের সঙ্গে থাকা বন্দিদের মধ্যে ভাগ করে দিচ্ছেন। সব সময় বলেন, আমরা ভাল খাবার খেতে পারলেও ওরা তো ভাল খাবার খেতে পারে না। তাই ওদেরকে বেশি করে দিতে হবে। সালাহউদ্দিনের নিকট আত্মীয় কলকাতা থেকে আসা আইয়ুব আলী জানালেন, ভাই খুব একটা খাবার খাচ্ছেন না। তবুও ভাইকে ডজনের পর ডজন কলা, আপেল, সবজি, রুটিসহ বিভিন্ন খাবার কিনে দিতে হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসব খাবার সেলে দিয়ে আসার পর পরই ভাই এসব খাবার বন্দিদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দেন। খাবারের পাশাপাশি প্রিজন সেলের বন্দিদের কাপড়চোপড় দিয়ে সহায়তা করছেন সালাহউদ্দিন। সেলে কর্মরত এক কর্মী জানান, বিএনপি’র সহ-দপ্তর সম্পাদক আব্দুল লতিফ জনি সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার পর তার কাছে কাপড়-চোপড় চেয়েছেন সালাহউদ্দিন। জনি জানতে চান কি কি কাপড়-চোপড় প্রয়োজন? প্রতি উত্তরে সালাহউদ্দিন জনিকে বলেন, ওরাতো গরিব মানুষ। ওদেরকে সহায়তা দিতে হবে। এ কারণে তাদের জন্যই কাপড় চেয়েছি। ইউটিপি রুমের তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদের নাম ওই তালিকার তিন নম্বরে রয়েছে। এছাড়া পুরুষ চিকিৎসাধীন বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন বিশাল গুরাং, গণেশ গৌরাঙ্গ, শুকাদউ রাই, সিলভারমুন সেতু ও আনন্দ রাই। অন্যদিকে মহিলা বন্দিদের মধ্যে রয়েছেন গ্রেস বাইপি ও নাগাইনু বাইপি। এ দুই চিকিৎসাধীন বন্দি আলাদা সেলে বসবাস করছে। তাদের কাছেও সালাহউদ্দিনের কাছ থেকে খাবার পৌঁছে যাচ্ছে। কাপড়-চোপড়ও পৌঁছে যাচ্ছে। এদিকে আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি ডাউকির কিছু শুভানুধ্যায়ী বিভিন্নভাবে সালাহউদ্দিনকে সহায়তা দিচ্ছেন। তারা এ বিএনপি নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে না পারলেও সালাহউদ্দিনের জন্য যেসব নেতাকর্মী ও আত্মীয়-স্বজনরা এসেছেন তাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন। ডাউকি’র খাসিয়া সম্প্রদায়ের স্ট্যালিন সিভিল হাসপাতালে জানান, আমাদের দেশে সালাহউদ্দিন বিপদে পড়েছে। তাকে সহায়তা দেয়া আমাদের দায়িত্ব। এ প্রেরণা থেকে তার আত্মীয়স্বজনদের নানাভাবে সহায়তা করছি।
[Adverts]
নিজে পালিয়ে গিয়েছেন ওখানে। বিএনপির অনেকেই আছে।