মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার উপকূলে খোলা সাগরে খাবার-পানি ও চিকিৎসার অভাবে এই মুহূর্তে মরণাপন্ন ৮ হাজারেরও বেশি আদম সন্তান। বেশিরভাগই রোহিঙ্গা মুসলিম হলেও তাদের মধ্যে বাংলাদেশি নাগরিকও কম নেই।
অনেকটা টিনে মুড়ি ঢোকানোর মত করেই মানুষগুলোকে ছোটো ছোটো নৌকায় ঠেসে গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এসেছে মানবপাচারকারীরা। খাবার তো দূরের কথা পানযোগ্য এক ফোঁটা পানযোগ্য নেই তাদের কাছে। অনেকে বাধ্য হয়ে নিজের মূত্র পান করছেন তারা।
বৃহস্পতিবার বিবিসির এক সাংবাদিক মালাক্কা প্রণালীর অদূরে আন্দামান সাগরে সাড়ে তিনশ’ আরোহীবাহী এ রকম একটি নৌকার কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হন। তিনি ওই নৌকার আরোহীদের নিজেদের মূত্রপান করতে দেখেছেন বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম।
বিপন্ন ওই মানুষদের চিত্র তুলে ধরে লস এঞ্জেলস টাইমস জানিয়েছে, সাংবাদিকদের নৌযান থেকে ওই সব নৌকায় পানির বোতল ছুঁড়ে দেয়া হলে সেখানে আরোহীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়।এ সময় নৌকার আরোহী নারী-শিশু-অসুস্থ মানুষগুলোর চোখে চিকচিক করে ওঠে কৃতজ্ঞতার অশ্রু।
এ মুহূর্তে এ রকম অনেকগুলো নৌকা ভেসে রয়েছে মালাক্কা প্রণালীর মালয়েশিয়া,ইন্দোনেশিয়ার ও থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন স্থানে।
পত্রিকাটি জানিয়েছে নৌকাগুলো এই মুহূর্তে উপকূলের কাছাকাছি অবস্থান করলেও তাদের তীরে ভিড়তে দিচ্ছে না কোনো দেশই।
এসব মানুষকে তীরে ভিড়তে দেয়ার না দেয়ার ব্যাপারে যথারীতি কঠোর থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়া। দেশগুলোর সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে তারা এ সব ‘অবাঞ্ছিত’দের গ্রহণ করবে না।
পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে যে, আপদ বিদায় করার অংশ হিসাবে এসব নৌকাকে বর্তমানে একে অপরের সমুদ্র সীমার মধ্যে ঠেলে দেয়ার হৃদয়হীন প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে তিন দেশের উপকূল রক্ষী বাহিনী।
এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার উপকূল রক্ষী বাহিনীর ফার্স্ট অ্যাডমিরাল তান কক কিউ বলেন,‘আমরা আমাদের জলসীমায় কোনো অবৈধ বিদেশি নৌকাকে ঢুকতে দেব না।’
আবার এসব নৌকার আরোহীরা ইন্দোনেশিয়ার বদলে মালয়েশিয়ায় যেতে আগ্রহী বলে নিজেদের দায় এড়িয়েছে ইন্দোনেশিয়া।
ইন্দোনেশিয়ার নৌবাহিনীর মুখপাত্র মানাহান সিমোরাঙ্কির সংবাদমাধ্যমকে এসব নৌকাকে ফিরিয়ে দেয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ‘তারা আমাদের ভূখণ্ডে অবতরণ করতে চায়নি। তাই তারা যেখানে যেতে চায় (মালয়েশিয়া) তাদের সেখানেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’
এমনকি এসব অসহায় শরণার্থীদের ওপর বর্বরতার গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে থাই নৌবাহিনীর বিরুদ্ধে। রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশি শরণার্থীবাহী অনেক নৌকাকেই টেনে নিয়ে গভীর সাগরে ফেলে রেখে এসেছে থাই নেভি। রোহিঙ্গাদের নৌকা লক্ষ্য করে গুলি চালানোর মত অমানবিক ঘটনাও ঘটিয়েছে তারা।
কিন্তু হঠাৎ করে কেন সমুদ্রে মানববাহী এত নৌকার ভিড়?
এ ব্যাপারে লস এঞ্জেলস টাইমস জানিয়েছে, সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মানব পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের কয়েকটি গণকবর আবিষ্কার হওয়ার পর নড়ে চড়ে বসে থাই সরকার। এতদিন থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার স্থানীয় রাজনীতিক ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ম্যানেজ করেই মানব পাচারকারীরা তাদের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলো। কিন্তু গণকবর আবিষ্কারের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হওয়ায় মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এ পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে থাইল্যান্ডের সমুদ্র উপকূলে মানব পাচারকারীদের স্থাপিত বন্দিশিবির থেকে পাচারের শিকার অবশিষ্ট মানুষদের নৌকায় তুলে মাঝ সাগরে ফেলে চম্পট দিয়েছে পাচারকারী ও তাদের দালালরা।
অপরাধের শেষ চিহ্ন মুছে ফেলতে পাচারের শিকার হওয়া মানুষদের মাঝ সমুদ্রে অনাহারে তিলে তিলে মারাই ছিলো তাদের পরিকল্পনা।এ যেন এক নীরব গণহত্যা।
ডেইলি বিস্ট, ইয়াহু নিউজ, গার্ডিয়ান ও রয়টার সহ অন্যান্য আরও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের খবর অনুযায়ী সাগরে ছেড়ে আসা এসব ছোটো ছোটো মাছ ধরার নৌকার কোনো কোনোটিতে ভরা হয়েছে সাত থেকে আটশ’জন করে মানুষকে।
এসব নৌকার অধিকাংশ আরোহীই মায়ানমারের নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম হলেও তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি।
এই বাংলাদেশিদের কেউ কম খরচে মালয়েশিয়া যাওয়ার প্রলোভনে পড়ে, আবার কাউকে কাউকে অপহরণ করে জোরপূর্বক মালয়েশিয়াগামী নৌকায় উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। পরে থাইল্যান্ডের বন্দিশিবিরে নিয়ে আটকে রেখে বাংলাদেশে তাদের পরিজনদের কাছে আদায় করা হয়েছে মুক্তিপণ।
এদিকে দিনের পর দিন সাগরে ভেসে থাকার কারণে খাবার পানির অভাবে ইতোমধ্যেই অর্ধমৃতে পরিণত হয়েছেন নৌকার আরোহীরা।
নৌকাগুলোতে শুরু হয়েছে মৃত্যুর মিছিল। নৌকাগুলোর কোনো কোনেটির সঙ্গে সংযোগ রক্ষায় সমর্থ হওয়া সাংবাদিকরা জানিয়েছেন নৌকার আরোহীদের কেউ না কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন প্রতি ঘণ্টাতেই। সময় যতই যাচ্ছে পরিস্থিতি ততটাই খারাপ হচ্ছে।মৃত হতভাগ্যদের সমুদ্রেই ছুঁড়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন নৌকার আরোহীরা।
সবচেয়ে দুর্বিষহ অবস্থা নারী ও শিশুদের। ধারণা করা হচ্ছে নৌকাগুলোর আরোহীদের কমপক্ষে ২০ শতাংশ নারী ও শিশু।
হাজার হাজার আদম সন্তান যখন এভাবে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তখন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ ও পশ্চিমা বিশ্বসহ আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা নির্লজ্জ বেহায়াপনারই নামান্তর।
সাগরে ভাসা মানুষগুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতার জন্য মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়া-থাইল্যান্ড সহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মুখপাত্র ফিল রবার্টসন বলেন, ‘তারা এসব মানুষকে মৃত্যু পর্যন্ত ভাসিয়ে রাখতে পারে না।’
ভূমধ্যসাগর কিংবা অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে অবৈধ অভিবাসীবাহী নৌকা উদ্ধারে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার ত্বরিৎ তৎপরতা চোখে পড়লেও, সাগরে ভাসমান বাংলাদেশি কিংবা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে তাদের যেন কোনো মাথা ব্যথা নেই।
দায়সারা বিবৃতি এবং নৌকার আরোহীদের উদ্ধারে একে অপরের প্রতি আহ্বান জানিয়েই জানিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে তারা।
এই ভাসমান মানুষদের উদ্ধারে এখনও চোখে পড়েনি জাতিসংঘ,যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব সহ আন্তর্জাতিক সংগঠনের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা উদ্যোগ।
ধারণা করা হয়, তাদের এই অকর্মণ্যতার মূল করা কারণ হলো উদ্ধারের পর রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত প্রশ্নে সিদ্ধান্তহীনতা।
মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও দেশটির নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে অন্যান্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গারা।
এমনকি বৈধভাবে দেশ ছাড়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও তাদের দিতে নারাজ দেশটির সরকার। ফলে বাধ্য হয়েই সাগরপথে এভাবে দেশ ছাড়ছেন রোহিঙ্গারা।
মায়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা ব্যাংককভিত্তিক একটি মানবাধিকার সংস্থার কর্মকর্তা ক্রিস লিয়া বলেন, সরকারি নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়ে ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা নাগরিক এভাবে নৌকায় করে দেশ ছেড়েছেন। তবে তাদের সবাই তাদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেননি। ধারণা করা হয় এভাবে যাত্রা করা প্রতি দশজনের অন্তত ১ পথিমধ্যেই মারা গেছেন। অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পাশাপাশি বেশিরভাগই মারা গেছেন পাচারকারীদের নির্যাতনে।’
রোহিঙ্গাদের ওপর মায়ানমার সরকারের নির্মম নিপীড়ন বন্ধে চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতাই আজকের এই সমস্যার মূল কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধে মায়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহ পশ্চিমা বিশ্বের সব সময়ই যেন চরম অনীহা।
এ ব্যাপারে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ব্যাংকক প্রতিনিধি ফিল রবার্টসন যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ানকে বলেন,এই মানুষগুলোর জীবন এখন চরম সঙ্কটে। এই মানুষগুলোকে সাগরে অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার অধিকার কারও নেই।
তিনি বলেন, অনেকগুলো নৌকা সাগরে ভেসে আছে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে। তাদের খাবার-পানি-জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে। সময় এখন তাদের বিরুদ্ধে।
সামনের ঘণ্টাগুলোতে ক্ষুধার্ত,তৃষ্ণার্ত এবং অসুস্থ এই মানুষগুলো একে একে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়বেন বলে আশঙ্কা করেন তিনি।
অসহায় এই মানুষগুলোকে উদ্ধারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতায় হতাশা প্রকাশ করেন ব্যাংককে অবস্থিত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার আঞ্চলিক যোগাযোগ কর্মকর্তা ভিভিয়ান তান।
তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত না এই মানুষগুলোকে উদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বা নেয়া হবে। এ ঘটনার কিভাবে সমন্বয় করা হবে সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার রাষ্ট্রগুলোর দ্বিমুখী আচরণ নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ডের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো জেরহার্ড হফস্টেডার।
দি কনভার্সেশনে নিজের নিবন্ধে তিনি বলেন, বঙ্গোপসাগরে গত কয়েক বছর ধরেই এ সঙ্কট চলে আসছে। কিন্তু সবার দৃষ্টি অস্ট্রেলিয়ার উপকূল ও ভূমধ্যসাগরের দিকে।
এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন প্রখ্যাত ফিলিস্তিনি-আমেরিকান সাংবাদিক রামজি বারুদ।সম্প্রতি তার এক নিবন্ধে তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো মায়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গাঢ় করার ব্যাপারে উদ্যোগী হলেও, দেশটির মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কোনো কথা বলছেন না তারা। লোক দেখানো বিবৃতি দিয়েই নিজেদের দায় সারছে তারা।
তিনি বলেন, মায়ানমারের অর্থনৈতিক সুবিধাগুলো ভাগ করে নেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা বিশ্ব। কিন্তু দেশটির মানবাধিকার রেকর্ড নিয়ে তাদের তরফে নেই কোনো উচ্চারণ।
এমনকি কয়েক বছর আগে মায়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেন সেন যখন নরওয়ের রাজধানী ওসলোতে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জেনস স্টোলটেনবার্গের সঙ্গে দেখা করেন তখন নরওয়ের তরফে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি শব্দও উচ্চারণ করা হয়নি। অথচ পশ্চিমাবিশ্বের যে সব সব দেশ মানবাধিকারের বড় বড় বুলি আওড়ায় তাদের মধ্যে নরওয়ে অন্যতম।
উল্টো রোহিঙ্গা সমস্যাকে মায়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে উল্লেখ করে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বার্মা সরকারকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদানের ব্যাপারে চাপ দিতে পারি না।’
এছাড়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিজের অবস্থান এখনও পরিষ্কার করতে পারেননি পশ্চিমা বিশ্বে গণতন্ত্রের শিখন্ডী হিসেবে সমাদৃত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মায়ানমারের রাজনীতিক অং সান সু চিও।বরাবরের মতই তিনি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে নিশ্চুপ। [Adverts]