বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ প্রসাধনী সামগ্রী নকল ও ভেজাল উপাদান দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে দেশে স্নো, সাবান, শ্যাম্পু, তেল, পারফিউমের মত পণ্যগুলো চাহিদার ৭০ শতাংশ নকল করা ও ভেজাল উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে।
ওই গবেষণায় উঠে এসেছে, স্থানীয় বিভিন্ন কারখানায় এই ভেজাল পণ্য তৈরির পর সেগুলো রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের বিপনিবিতানে বাজারজাত করা হয়।
আর এসব প্রসাধনী পণ্যের ক্ষতিকারক দিক সর্¤úকে ক্রেতা এবং বিক্রেতা জানেন না বললেই চলে।
এ বিষয়টি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিবিসি বাংলা একটি বিশেষ প্রতিবেদন করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ফুটপাত থেকে অভিজাত বিপনিবিতানগুলোয় নকল ও ভেজাল প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে।
ফারিয়া নামের একটি মেয়ে ঢাকার একটি বড় নামকরা প্রসাধনী দোকান থেকে প্রসাধনী কিনছেন ফারিয়া। প্রতিদিনের মাখা সাবান স্নো ক্রিম লোসন সেম্পু একবারে কিনে নেন। আসল প্রসাধনী পণ্য কিনতেই তিনি নামকরা এই প্রসাধনী দোকান থেকে পণ্য গুলো কিনের সবসময় ।
ফারিয়া বলেন, ত্বক আমাদের অনেক সেনসিটিভ। তাই ত্বকের জন্য এক নাম্বার প্রসাধনী কিনতে এখানে আসি। যেহেতু ত্বকে জিনিসটা ব্যবহার করা হবে। তা না হলে দেখা যাবে ত্বকে পিমপিলস উঠছে। তাই এই দোকানে অসি। কারণ জানি অন্তত তারা দু’নাম্বার জিনিস দিবে না। এতে মানসিক একটা প্রশান্তি কাজ করে। তাই এখান থেকে কিনা।
শপিংমলের অন্য দোকান গুলোতে সমান ভিড়। দেশী পণ্যের পাশাপাশি এসব দোকানে বিদেশী বিভিন্ন নামী ব্রান্ডের পণ্য দেখা গেছে। কথা হয় তেমনি একটি দোকানের মালিকের সাথে।
তিনি জানান, এসব পণ্য কোম্পানির ডিস্ট্রবিউটরা দিয়ে যায়। বিদেশী আমদানিকারকরাও আছে তারাও ডিস্ট্রবিউটরদের মাধ্যমে প্রতি দোকানে দোকানে জিনিসগুলো দিয়ে যায়।
তিনি বলেন, আমরা বুঝতে পারি এখানে আমদানিকারকরা পুরো ঠিকানা সীল বিএসটিআই অনুমোদিত দেওয়া থাকে। আর তারা প্রতিদিন আমাদের পন্য দিয়ে যায়। এভাবে আমরা বুঝতে পারি। আর হকাররা আজ পণ্য দিলো কাল হাঠাৎ গায়েব। কিছু অবিশ্বাস থাকে তারা তখন দু’নাম্বার পণ্য দিয়ে যায়। কিন্তু কোম্পানির লোকরা প্রতিদিন এসে পণ্য দিয়ে যায়। তখন সন্দেহ থাকে না এবং আমরা দেখলেই বুঝি পারি কে আসল কে নকল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, দেশে যে পরিমান কসমেটিকসের চাহিদা রয়েছে তার ১৫ শতাংশ পুরণ হচ্ছে দেশীয় পণ্য দিয়ে আর ১৫ শতাংশ পূরণ করা হয় বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্য দিয়ে। বাকি ৭০ শতাংশ পণ্য নকল ও ক্ষতিকারক উপাদান দিয়ে তৈরি হচ্ছে।
ঢাকা চকবাজারে কসমেটিকস মার্কেটের খোঁজ করতেই দেখিয়েই দিল সবাই। রাস্তার দু’ধারা এবং দু’তিন তলা ভবনে সারি সারি দেখো গেল কসমেটিকসের দোকান। এই দোকানগুলোতে পাইকারীহারে বিক্রি হয় পণ্য। দেশী-বিদেশী পণ্যের পাশাপাশি বিক্রি হয় তাদের ভাষায় দু’নাম্বার পণ্য। পুলিশ অভিযানের ভয়ে দু’নাম্বার পণ্যের খোঁজ দিতে চায় না।
এমনি এক দু’নাম্বার কসমেটিকস দোকানদারের সাথে কথা হয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, সব ব্র্যান্ডেরই দু’নাম্বার পণ্য আমাদের কাছে আছে। পন্ডস পাউডার, সানসিল্ক শেম্পু, হিমালিয়া ছোট বড় ফেসওয়াস, ডাভ ছোট বড় শেম্পু, গোল্ড ক্রিম, তেল ভাটিকা, কুমারিকা, আমলা আছে।
এসব পণ্য কি দু’নাম্বার জানতে চাইলে কসমেটিকস দোকানদার বলেন হ্যাঁ সব দু’নাম্বার। আপনারা এগুলো এখানে কিভাবে করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চায়না থেকে কনটিনার করে আসে।
আপনারা কি এখানে কারখানায় তৈরি করেন এসব পণ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, হ্যাঁ এখানেই তৈরি করি আমরা। আমাদের ক্রেতা অনেক জায়গায় আছে। যশোর, খুলনা, চিটাগাং, কুষ্টিয়া আছে তারা ফোন করে পণ্য চাইলে ছোট-বড় বক্স করে পাঠিয়ে দেই।
যেসব জায়গার কথা বললেন ওইসব এলাকার দোকানে এইসব পণ্য যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন হ্যাঁ যাই। ওরা ফোন করে যা চাই তাই আমরা এখান থেকে পাঠিয়ে দেই। বাজারে যে দাম আছে তার অর্ধেক দাম এই আর কি। এতোটুক ছাড় দেওয়া হয়।
আপনি যে পণ্যগুলোর নাম বললেন সেসব পণ্যে কি কম দামে দেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, অর্ধেক দামে দেই। যেমন হিমালিয়া তেলের দাম ১৪৫ টাকা তারা দিবে ৫০ টাকা।
পণ্যে যে উপাদান ব্যবহার করা হয় তাতে কোন ক্ষতি করে না কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব পণ্যে যে উপাদান ব্যবহার করা হয় তাতে কোন ক্ষতি করবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের গবেষণায় বলে হচ্ছে ঢাকার ইসলামপুর, চকবাজার, জিনজিরাসহ ঢাকার বাইরে এসব ভেজাল পণ্যের কারখানাগুলো গড়ে উঠছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ বলেন, ‘‘কসমেটিকসের ক্ষেত্রে আমরা দেখি ফরমালিহাইড সিভিআর এলার্জি তৈরি করে এবং এ থেকে বিভিন্ন রোগের উপসর্গ তৈরি হয়। আমরা তখন পরীক্ষা করে দেখলাম যে পরিমাণ ফরমালিহাইড থাকলে শরীরে ক্ষতি হবে না কিন্তু ত্তইসব পণ্যে তার চেয়ে বেশি পরিমাণ দেয়া হয়। যা অত্যন্ত ক্ষতি করে শরীরে। এটা দেশী-বিদেশী সব পণ্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। পিজারভেটিভ ও এন্টি-অক্রিজেন ব্যবহার বাধ্যতামূলক থাকে। আরেকটা হল ইউভিপ্রটেকটেট যা অনেক বেশি পরিমাণ থাকে তা আমাদের শরীরে এলার্জি তৈরি করে। আমাদের দেশে কসমেটিকস পণ্য তৈরিতে সঠিক নিয়ম মানা হয়না। নি¤œমানের কেমিক্যাল দিয়ে আমদের দেশে প্রসাধণী সামগ্রী দিয়ে পণ্য তৈরি করা হয় যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।’’
বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম বিভাগের অধ্যাপক (অব:) লে. কর্ণেল আবদুল ত্তহাব বলেন, ‘‘আমাদের এখানে যারা চিকিৎসা নিতে আসে সাধারণ একটা কালো দাগের চিকিৎসা নিতে আসছে। উল্টো একশান হয়ে সাদা হয়ে গেছে। এমনি কসমেটিকস ব্যবহার করছে দেখা যায় ত্বক লাল, চুলকায়, ভিতরে ছোট ছোট দানা হয়ে গেছে। তার পরে দেখা যায় অতিরিক্ত ঘাম ঝরছে, সিভিআর এলার্জি হয়। চুলে বিভিন্ন রকম প্রসাধনী ব্যবহারে চুলের গোড়ায় ঘাঁ হয়। সিভাইরি একশানে অনেকে আবার মারা যাচ্ছে। একটা প্রসাধনী বেশি দিন ধরে ব্যবহার করলে খারাপ একশান করে মৃত্যু ঘটাতে পারে।