বিচারপতিদের অভিশংসন-সংক্রান্ত বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী ইতোমধ্যে পাস হয়েছে জাতীয় সংসদে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়ার কথা আগে বলা হলেও শেষ পর্যন্ত সরকারের অনীহায় তা হয়নি। তবে অভিশংসনের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি ও এ-সংক্রান্ত আইন প্রণয়নে এবার সংশ্লিষ্ট সব মহলের সঙ্গে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামী জানুয়ারিতেই এ বিষয়ে আলোচনা করে আইন প্রণয়ন করা হবে বলে আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
বিচারপতিদের অভিশংসন-সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী প্রস্তাব সংসদে ওঠে গত ৭ সেপ্টেম্বর। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অভিশংসনমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ‘সংবিধান (ষোড়শ সংশোধন) বিল-২০১৪’ সংসদে উত্থাপনের পর বিলটি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়ে দেন স্পিকার। ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদে পাঠানো কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা কখনোই সংসদের হাতে যাবে না। সংসদ শুধু সুপারিশ করার ক্ষমতা পাবে। অভিশংসনের ক্ষমতা থাকবে রাষ্ট্রপতির হাতে, যিনি নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। তবে বিলটি সংসদীয় কমিটিতে এলে সুপ্রিম কোর্ট, বার কাউন্সিল, এমনকি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিরও মতামত নেওয়ার কথা ছিল। তবে সরকার কারও সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে অনাগ্রহী হওয়ায় কমিটি বিষয়টি বাদ দেয়। তবে কমিটি তাদের বক্তব্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করে অন্যভাবে। তাতে বলা হয়, “আমরা ’৭২-এর সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৬ হুবহু প্রতিস্থাপন করেছি। এখানে নতুন কিছু নেই। এ কারণে কারও সঙ্গে আলোচনারও দরকার নেই। উত্থাপিত বিলে কোনো বিচারপতির অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে ‘তদন্ত ও প্রমাণ’ আইন করে সংসদের নিয়ন্ত্রণ করার শর্ত রাখা হয়েছে।” এর ব্যাখ্যায় বলা হয়, কোনো বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তাকে অপসারণ করা যাবে না। এর জন্য ফলোআপ আইন হবে। ওই আইনে তদন্ত কমিটির বিধান থাকবে। এই কমিটি সংশ্লিষ্ট, দায়িত্বশীল, প্রাসঙ্গিক লোকদের দিয়ে করা হবে। যেখানে জুডিশিয়ারি থেকেও লোক থাকবেন। তারা সংসদে বিষয়টি পাঠালে সংসদ শুধু অনুমোদন দেবে। অপসারণের মতা রাষ্ট্রপতির।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আগামী মাসের শুরুর দিকে বিচারপতিদের অভিশংসন-সংক্রান্ত ফলোআপ আইনটি করার কাজ শুরু হবে। তখনই দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট বার, রাজনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে জামায়াতের কারও সঙ্গে আলোচনা করা হবে না। সূত্র আরও জানায়, নতুন আইনে বিচারপতিদের স্বাধীনতার বিষয়ে নজর দেওয়া হবে। যেন অভিযোগ উঠলেই কাউকে অপসারণ করা না যায়। অভিশংসনের জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটির বিষয়েও এতে উল্লেখ থাকবে। এসব বিষয় নিয়েই সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করবে সরকার।
এ প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে অভিশংসন-সংক্রান্ত নতুন আইন শিগগির প্রণয়ন করা হবে। সংবিধান সংশোধনের সময় কেন এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো না- এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, তখন প্রয়োজন হয়নি। এখন আইন করার সময় আলোচনা করব। কারণ আইনের মাধ্যমেই সবকিছু কার্যকর করা হয়।
আলোচনার ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষেত্রে যে আইনটি হবে সেটিই আসল। তাই এর জন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই ভালো হবে। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন, বিচারপতিদের অভিশংসন আইনের ব্যাপারে সবার সঙ্গে আলোচনা করার উদ্যোগ ভালো। তবে সংসদে বিলটি পাশের আগেও এ বিষয়ে আলোচনা করা উচিত ছিল। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এ ব্যাপারে বলেন, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল। বিচারপতিদের অভিশংসন-সংক্রান্ত সংবিধান সংশোধন তো হয়েই গেছে। এখন আলোচনার তেমন কিছু নেই।
উল্লেখ্য, বিচারপতিদের অভিশংসন-সংক্রান্ত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, বিচারকদের পদের মেয়াদ- (১) এই অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সাপেে কোনো বিচারক ৬৭ বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকবেন। (২) প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যরে কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত বিচারককে অপসারিত করা যাবে না। এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবেন। (৪) কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ করে স্বীয় স্বারযুক্ত পত্রযোগে নিজে পদত্যাগ করতে পারবেন।
এদিকে, বিচারকদের অভিশংসনের মতা সংসদের হাতে চলে যাওয়ায় সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের অপসারণের ক্ষমতাও পেয়েছে সংসদ। এই পদের অধিকারীরা হলেন উচ্চ আদালতের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানসহ সব কমিশনার, প্রধান তথ্য কমিশনারসহ সব কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ এর সদস্যরা এবং মহা হিসাব নিরীক্ষক। নতুন আইনে তাদের অপসারণ-প্রক্রিয়ারও উল্লেখ থাকবে, যা করা হবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে। সূত্র এমনটাই জানিয়েছে।