রাজনীতিতে নতুন করে রহস্য ছড়াচ্ছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে নতুন করে নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতি ও আগাম নির্বাচনের জন্য বিদেশিদের অব্যাহত চাপের মুখে থাকার প্রেক্ষাপটেই রহস্য ছড়ানোর কাজে তৎপর হয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাতীয় পার্টির এক সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দলের ভেতরে ও বাইরে নতুন করে রহস্যের জাল ফেলেছেন স্যার (এরশাদ)। সম্প্রতি মালয়েশিয়া সফর শেষে দেশে ফিরে নতুন রহস্য ছড়াচ্ছেন; দ্বিধাবিভক্ত দলের মধ্যে কথা বলছেন; নতুন কিছু ঘটার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর বিরোধীদলীয় প্রধান হওয়ার জন্যও রওশন এরশাদের সঙ্গে তুমুল দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। অথচ হঠাৎ নিজের নিকট অতীত ভুলে গিয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক নতুন রহস্যে মন মজিয়েছেন। এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে এরশাদের নতুন উদ্দীপনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় পরিবর্তনের একটি ঈঙ্গিত বহন করছে। আগাম নির্বাচন নিয়ে বর্তমান সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত থাকলে এবং পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হলে আরও নানা রহস্য সৃষ্টি করায় মনোনিবেশ করবেন তিনি। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গত মাসের মালয়েশিয়া সফরে গিয়েছিলেন এরশাদ। ২৯ নভেম্বর রাতে তিনি ফিরেছেন। ওই সফরে মালয়েশিয়া বসে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহসিচব তারেক রহমানের একদল প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয়েছে এরশাদের। সেখানে দেশের বর্তমান রাজনীতি এবং তার অবস্থান নিয়ে কথা হয়েছে। তবে ওই আলোচনায় তারেক রহমানের পক্ষে কে কে প্রতিনিধি হিসেবে ছিলেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেনি।
এদিকে দেশে ফিরে দলের এমপিদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের বিষয়ে বক্তব্য রেখে জাতীয় পার্টিতে আবারও ‘অস্বস্তি’ ও রহস্যের সৃষ্টি করেন এরশাদ। বুধবার রংপুরে তার বাসভবনে সাংবাদিকদের বলেন, জাতীয় পার্টির এমপিদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের বিষয়ে দলে আলোচনা চলছে। তবে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, ২৮ নভেম্বর বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে ঢাকায় সফরে আসা মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বৈঠক করেন। সেখানে জাতীয় পার্টির এমপিদের সরকারে থাকা-না থাকা নিয়ে কথা ওঠে। ওই দিন নিশা দেশাই জাতীয় পার্টির তিন সংসদ সদস্যের সরকারে থাকার পাশাপাশি সংসদে বিরোধী দলে ভূমিকা রাখার বিষয়টি জানতে চান। তখন রওশন বলেন, বিষয়টি নিয়ে তারাও চিন্তাভাবনা করছেন। দলের নীতিনির্ধারণী পরিষদে আলোচনা করে এ বিষয়ে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
জাতীয় পার্টির সূত্রগুলো জানায়, এরশাদ ও রওশন দুজনই জাতীয় পার্টিকে সংসদে সত্যিকারের বিরোধী দল হিসেবে দেখতে আগ্রহী। সেজন্য মন্ত্রিসভায় থাকা দলের তিন এমপির পদত্যাগ করা উচিত বলে মনে করেন তারা। তবে রওশন এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু না বললেও এরশাদ এর আগে আরও কয়েকবার দলের এমপিদের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের কথা বলেছিলেন। এ নিয়ে একবার মন্ত্রিসভার দুই সদস্য মুজিবুল হক ও মসিউর রহমান এবং দলের আরেক নেতা তাজুল ইসলাম চৌধুরী এরশাদ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন।
জাতীয় পার্টি সূত্র আরও জানায়, সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দফায় দফায় ভাঙন অস্থিরতার কারণে ইমেজ সঙ্কটে পড়ে এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি বর্তমানে নাজুক অবস্থায়। প্রেসিডিয়াম, ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদকসহ পুরো কেন্দ্রীয় কমিটিতে নানা গ্রুপ ও উপগ্রুপ। এছাড়া ভেতরে ভেতরে চলছে তিন ধারার রাজনীতি। এরশাদের ভাই জিমএম কাদের, সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ও অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন রয়েছেন একটি অংশে, আর অপর একটি ধারায় রয়েছেন বর্তমান মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু ও ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও রোজাউল ইসলাম ভূইয়া। অন্য একটিতে রয়েছেন রওশন এরশাদ, বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা। আর এ তিন ধারাই এখন বড় সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতীয় পার্টিতে। এসব নিয়ে অনেকটা সঙ্কটকাল অতিক্রম করছেন এরশাদ। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজছেন তিনি। এজন্য এরই মধ্যে দলের শীর্ষ নেতাদের তিনটি ধারার সঙ্গেই এরশাদ যোগাযোগ রেখে চলছেন। নিয়মিত তাদের সঙ্গে কথা বলছেন। কীভাবে দলকে আবার শক্তিশালী করে ভালো অবস্থানে নেয়া যায়, সেজন্য সবার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যেমে সমাধানের পথ খুঁজছেন। রওশন এরশাদের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে আলোচনা করেছেন তিনি। দলকে চাঙ্গা করতে দুইজননেই একমতে পৌঁছেছেন। খুব শিগগির দলের নতুন নেতৃত্বের পাশাপাশি নতুন করে দল সাজানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়ে মাঠে নামার প্রত্যয় তাদের।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও পানিসম্পদমন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টি সরকার পতনের জন্য নয়, আন্দোলন করবে জনস্বার্থ রক্ষার্থে। ১ জানুয়ারি থেকেই জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হবে। সেদিন আমরা প্রমাণ করব, জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, তোমরা সর্বশক্তি দিয়ে এ মহাসমাবেশ সফল কর। তাহলেই জাতীয় পার্টি আগামীতে ক্ষমতায় যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, জাতীয় রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেই ‘রহস্যমানব’ হয়ে ওঠেন এরশাদ। দলের ভেতরে ও বাইরে এক রহস্যের জাল ফেলে দেন তিনি। দশম সংসদ নির্বাচনের আগে এরশাদের এ ‘রহস্যময়’ আচরণের জট এখন পরিষ্কার। বিএনপিকে ছাড়া শেষ পর্যন্ত দশম সংসদ নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ ছিল দেশের সব মহলে। ওই অনিশ্চয়তার কারণেই একাধিক মামলার আসামি এরশাদ চাইছিলেন সব পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে। এভাবে তিনি শেষ পর্যন্ত বাতাস যেদিকে যায়, সেদিকেই হেলে যাওয়ার পথ খোলা রেখেছিলেন। হয়েছেও তাই। ব্যাপক নাটকীয়তা, লুকোছাপা করে অবশেষে সংসদ সদস্য হিসেবে শপথও নিয়েছিলেন। এখন আবার আগাম নির্বাচনের জন্য ক্ষমতাসীন দল বিদেশিদের অব্যাহত চাপের মুখে থাকার প্রেক্ষাপটেই রহস্য ছড়ানোর কাজে তৎপর হয়েছেন তিনি।