একের পর এক নাটক। মঞ্চে অভিনেতা একজনই। তিনি সাবেক সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে তার দ্বৈত অবস্থান জন্ম দিচ্ছে নানা নাটকীয়তার। জাতীয় পার্টি সরকারে আছে। বিরোধী দলেও আছে। দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করছে দলটি। কখনও সরকারের পক্ষে, কখনও সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পার্টির চেয়ারম্যান, বিরোধী দলের নেতাসহ দলের নেতারা কথা বলছেন। এমন দ্বৈত ভূমিকার কারণে জাতীয় পার্টি এখন অনেকের কাছে হাসির পাত্র। দলের নেতাদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ, হতাশ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তৃণমূলই ছিল এক সময় এরশাদের রাজনীতির কেন্দ্র এখন সেই তৃণমূলেই তিনি সমর্থনহীন। দল এবং নিজের জনপ্রিয়তা তলানিতে। ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর এরশাদ ও তার দলের একের পর এক নাটকীয় আচরণ ও ঘটনাক্রমে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছে জাতীয় পার্টিকে। দলের নেতারা দলকে পুনর্গঠনের কথা বললেও ক্রমে তৃণমূলে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে এরশাদের হাতে গড়া এই দল। দলের নেতাদের দ্বৈত ভূমিকার কারণে দলে এবং বাইরে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা সন্দেহ ও সংশয়। সূত্র বলছে, একই সঙ্গে সরকারে থাকা এবং বিরোধী দলে অবস্থান এ দুটিকে দেখাতেই নেতারা দ্বৈত অবস্থানে অবতীর্ণ হচ্ছেন। একই সঙ্গে তারা সরকারের প্রশংসা করছেন। কখনও কখনও সরকারের ভাষায় সাবেক বিরোধী দলের সমালোচনা করছেন। আবার কখনও তারা সরকারের সমালোচনায় মুখর হচ্ছেন। গতকাল দুপুরে এরশাদ বলেছেন, যে সরকার জনগণের নিরাপত্তা ও সুশাসন দিতে পারে না সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার কোন অধিকার নেই। ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে তারা প্রয়োজনে রাজপথে নামবেন। পাশাপাশি দলীয় নেতা-কর্মীদের এরশাদ সরকারের ব্যর্থতা এলাকায় গিয়ে তুলে ধরার নির্দেশ দেন। জাতীয় পার্টি নেত্রী রওশনও সরকারের পক্ষে-বিপক্ষে মাঝে মধ্যে বক্তব্য রাখেন। আর দলটির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু সম্প্রতি অভিযোগ করেন, দেশে সুশাসন নেই। এভাবে চললে ইতিহাসই সরকারকে মূল্যায়ন করবে। তবে সহসা কিংবা মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রশ্নে তাদের কারও অবস্থান পরিষ্কার নয়। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের আগে পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ একাধিকবার বলেছিলেন, নির্বাচনও করবো না, শপথও নেবো না। রওশনের নেতৃত্বে তার দলের একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয়। তিন জন মন্ত্রী হন। আর নানা নাটকীয়তার পর এরশাদ এমপি হিসেবে শপথ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়ে বাসায় ফেরেন। একটি বেসরকারি টিভির ঈদের অনুষ্ঠানে এরশাদ বলেছেন, যে কোন সময় জাপার তিন মন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন। এ প্রশ্নে জাতীয় পার্টির মহাসচিব বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান কখন কি বলেছেন তা পরিষ্কারভাবে টিভিতে প্রচার করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে তিন মন্ত্রী পরে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের যদি পদত্যাগই করতে হয়, তাহলে সবার আগে পদত্যাগ করা উচিত প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এরশাদের। এরশাদের ভাই জিএম কাদের সরকারের কড়া সমালোচনা করায় জাপার একটি অনুষ্ঠান থেকে উঠে যান মহাসচিব বাবলু। জাপার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এরশাদসহ দলটির নেতারা নাটক করছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসলে সরকারের সমালোচনা নয়, সরকারের নির্দেশেই তারা এমন বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য প্রচার করার জন্য অনেক গণমাধ্যম কর্মীকেও তারা অনুরোধ করছেন।
মতবিনিময় সভায় এরশাদ যা বলেন: শনিবার দুপুরে বনানীর রাজনৈতিক কার্যালয়ে এরশাদ বলেন, যে সরকার জনগণের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সুশাসন দিতে পারে না সেই সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। দেশের মানুষ দুই দলকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সরকারের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে জাতীয় পার্টি রাস্তায় নামবে। তিনি বলেন, মানুষ এখন পরিবর্তন চায়, স্বস্তিতে থাকতে চায়, বাঁচতে চায়, নির্ভয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে চায়। তিনি বলেন, কত মানুষ নিরুদ্দেশ। ছেলে-মেয়েরা তাদের জন্য অপেক্ষায়। তারা ফিরে আসবে কিনা, তা কেউ জানে না। কে কখন কাকে তুলে নিয়ে যাবে তা-ও কেউ জানে না। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমরাও সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামবো। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্রের মূল্য থাকবে না। মানুষ এখন নিরাপত্তাহীনতায় বসবাস করছে। দখলদারী, দুঃশাসন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসের কারণে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। মানুষ এ থেকে পরিত্রাণ চায়। দু’টি দল জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। তাদের ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার কোন অধিকার নেই। বিএনপির মতো পেট্রল দিয়ে মানুষ মেরে বা জ্বালাও-পোড়াও করে আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই না। আমাদের আন্দোলন হবে শান্তিপূর্ণ। সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ বলেন, পেট্রল দিয়ে মানুষ মেরে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। এজন্যই এখন মানুষ বিএনপিকে দেখতে পারে না। তবে মানুষ পরিবর্তন চায়। তিনি বলেন, নতুন করে আমাদের সংগঠিত হতে হবে। অতীতে কি হয়েছে তা ভুলে যেতে হবে। সময় এসেছে। আমরাও রাস্তায় নামবো। আমরা মানুষকে অনেক দিয়েছি। এবার ক্ষমতায় গিয়ে নিরাপত্তা দেবো। এরশাদ বলেন, আমার বিরুদ্ধেও আন্দোলন হয়েছে। তবে সারা দেশে হয়নি। আন্দোলন হয়েছে শুধুমাত্র ঢাকায়। হাতে রক্ত লাগিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না। আমরা কাকে মারবো? ওরা তো আমাদেরই ভাই, সন্তান। এরশাদ দুঃখ করে বলেন, এখন নিঃশ্বাস নেয়ার মতো অবস্থা নেই। মুখেই সংসদীয় গণতন্ত্র। মানুষ এ থেকে বাঁচতে চায়। আমরা সুশাসন দিয়েছিলাম। আর এই সরকারের সময় ! ব্যাংক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এই লুটপাটের কারণেও সরকারের ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে এরশাদ বলেন, সরকারের ব্যর্থতা এলাকায় গিয়ে তুলে ধরতে হবে। খুন, গুম, দলীয়করণ আর দখল ছাড়া কিছুই নেই সরকারের। এ ভাবে দেশ চলতে পারে না। মানুষকে এসব বলতে হবে। আগামীতে আমরা ক্ষমতায় যেতে চাই। আমাদের লক্ষ্য ১৫১ আসন। এই জন্য দল গোছাতে হবে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। সভায় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ, শরীয়তপুর জেলা জাতীয় পার্টি নেতা এডভোকেট মাসুদুর রহমান ও জাফর খান কামাল বক্তব্য রাখেন। এ সময় পার্টির প্রেসডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায়, দফতর সম্পাদক সুলতান মাহমুদ, যুগ্ম সাংগঠনিক সম্পাদক নাসির উদ্দিন শিকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।