জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ তুলে ধরতে গিয়ে বারবার ভুল করায় আদালতে প্রশ্নের মুখে পড়লেন প্রসিকিউটর মোহম্মদ আলী।
এই মামলায় যুক্তিতর্ক শুনানিতে মঙ্গলবার বিচারক এই প্রসিকিউটকে বলেই বসেন, “আপনি তো মুরগির রেজালা রান্না করতে গিয়ে মাঝখানে হালুয়ার রেসিপি শুরু করে দিলেন।”
নিজামীর মামলাটি গত বছরের শেষ দিকে রায়ের জন্য অপেক্ষমানের তালিকায় চলে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি এটিএম ফজলে কবীর।
তিনি অবসরে যাওয়ায় নতুন চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম দায়িত্ব নেয়ার পর আবার নতুন করে যুক্তিতর্ক শুনানি শুরু হয়েছে।
প্রসিকিউশনের পক্ষে সোমবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু করেন মোহম্মদ আলী। একাত্তরে ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা নিজামীর অপরাধ যে শাস্তিযোগ্য, তা প্রমাণে মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো যুক্তি তুলে ধরেন তিনি।
এদিন নিজামীর বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১১টির বিষয়ে প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের দেয়া সাক্ষ্য ও নথিপত্র তুলে ধরে বক্তব্য দেন মোহম্মদ আলী।
ত্রয়োদশ অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ নিয়ে আলোচনার সময় তিনি একটি প্রদর্শনীর ক্রমিক সংখ্যা বেশ কয়েকবার ভুল করেন।
বারবার ভুল করায় বিচারক আনোয়ারুল হক তাকে বলেন, “আপনি তো মুরগির রেজালা রান্না করতে গিয়ে মাঝখানে হালুয়ার রেসিপি শুরু করে দিলেন।”
যুক্তিতর্কে একাদশ থেকে চতুর্দশ অভিযোগ একই ধরনের হওয়ায় এগুলোর যুক্তিতর্কে একই কথা বারবার বলতে থাকায় এক পর্যায়ে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান ইনায়েতুর রহিম প্রসিকিউটরকে বলেন, “আপনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করছেন কেন?”
এরপর প্রথম অভিযোগের বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের এক পর্যায়ে নথির একটি পৃষ্ঠা সংখ্যা মোহম্মদ আলী ভুল করলে সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেই পৃষ্ঠা নম্বর ঠিক করে দেন।
দ্বিতীয় অভিযোগের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় ওই অভিযোগের চারজন সাক্ষীর মধ্যে একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যের বিষয়ে কোনো আলোচনা করেননি প্রসিকিউটর।
তখন বিচারক জাহাঙ্গীর হোসেন জিজ্ঞাসা করেন, “১৮ নম্বর সাক্ষী নিয়ে কিছু বলবেন না?”
উত্তরে প্রসিকিউটর বলেন, “আপনারা কী মনে করেন জানি না, তবে আমি ভেবেছিলাম আমি এ অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করেছি।”
মোহম্মদ আলী প্রথম থেকে সপ্তম এবং একাদশ থেকে চতুর্দশ অভিযোগ নিয়ে এদিন আলোচনা করেন। এ অভিযোগগুলো মধ্যে রয়েছে মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা করা, অপরাধ সংঘটনে উস্কানি ও নির্দেশ দেয়া, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, নির্যাতন ও দেশত্যাগে বাধ্য করা।
মোহম্মদ আলীর পাশাপাশি প্রসিকিউশনের পক্ষে তুরীন আফরোজও এ মামলায় আইনি দিকগুলো নিয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবেন।
এই মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপন নিয়ে তুরীনের সঙ্গে মোহম্মদ আলীর বিরোধের খবরটি বেশ আলোচিত। পরে প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মন্ত্রী নিজামীকে ২০১০ সালের ২৯ জুন একটি মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বছরের ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এরপর গত বছর ১১ ডিসেম্বর জামায়াতের আমিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন। ২৮ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগ আমলে নেয়।
নিজামীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তার মধ্যে একাত্তরের ডিসেম্বরে পাবনার বেড়া থানার বৃশালিকা গ্রাম ঘেরাও করে ৭০ জনকে গুলি করে হত্যা ও ৭২টি বাড়িতে আগুন দেয়া, ডেমরা ও বাউশগাড়ী গ্রামে ৪৫০ জনকে গুলি করে হত্যা, সাঁথিয়া উপজেলার করমচা গ্রামে মন্দিরের সামনে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনাও রয়েছে।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশে বলা হয়, ১৯৪৩ সালে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে জন্ম নেয়া নিজামী ১৯৬৩ সালে কামিল পাস করেন। জামায়াতের তখনকার ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রধান হিসাবে একাত্তরে তিনি ছিলেন আলবদর বাহিনীরও প্রধান।
স্বাধীনতাকামী বাঙালির ওপর দমন-পীড়ন চালাতে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য গঠিত রাজাকার বাহিনী ও শান্তি কমিটিতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক খানের জবানবন্দি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে গত বছর ২৬ অগাস্ট এ মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেন মোট ২৬ জন।
আর নিজামীর পক্ষে তার ছেলে মো. নাজিবুর রহমানসহ মোট চারজন সাফাই সাক্ষ্য দেন। বাকি তিনজন হলেন- অ্যাডভোকেট কে এ হামিদুর রহমান, মো. শামসুল আলম ও আবদুস সালাম মুকুল।