দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকার ও মন্ত্রিপরিষদ গঠনের খুব বেশিদিন হয়নি। তবে এর মধ্যেই নানা কর্মকাণ্ডের জন্য বির্তকিত হয়ে উঠেছেন বেশ কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। তাদের কর্মকাণ্ডে ব্যাপক সমালোচনা হয় দেশজুড়ে। এতে বিব্রত আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় নেতারা। এ নিয়ে তারা অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন।
সর্বশেষ শুক্রবার পটুয়াখালীর বাউফলে এক গণসংবর্ধনায় জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজের দেয়া বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় উপঢৌকন হিসেবে নগদ টাকা চান।
এছাড়া সম্প্রতি স্কুলের শিশুদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে সংবর্ধনা, সোনার নৌকা উপহার নেয়া, রায়ের ব্যাপারে বিচারপতিকে মন্ত্রীর ফোন, অনুষ্ঠান মঞ্চে মন্ত্রীর ধূমপান ইত্যাদি ঘটনায় ব্যাপক সমালোচিত হয়েছে সরকার।
ক্রেস্ট নয়, ক্যাশ চাই :
রাজনৈতিক সংবর্ধনায় আ স ম ফিরোজ জনতার কাছে ক্যাশ চান। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের দেওয়া ক্রেস্ট গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে মাইকেই ঘোষণা দেন উপঢৌকন হিসেবে নগদ (ক্যাশ) অর্থ গ্রহণের।
অর্থ গ্রহণের যুক্তি হিসেবে জনসমক্ষেই চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেন, “নির্বাচন করতে অনেক টাকা লাগে, ক্যাশ দিয়েন, ভালো হয়।”
অনুষ্ঠানটি স্থানীয় ক্যাবল অপারেটরদের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। হুইপ ফিরোজের ওই বক্তব্যের ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে জেলার সর্বত্র। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভিডিওটি।
বিচারপতিকে মন্ত্রীর ফোন :
হাইকোর্টে বিচারাধীন মামলার রায়ে পক্ষে নিতে বিচারপতিকে ফোন করেন সরকারের এক মন্ত্রী। মন্ত্রীর ফোনের পর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট ডিভিশন বেঞ্চ বিব্রতবোধ করে মামলাটি যাবতীয় নথিসহ পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দেন।
এ ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় গোটা বিচার অঙ্গনে। ঘটনাটি এখনও আইনজীবী, সরকারি আইন কর্মকর্তা ও বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মুখে মুখে।
বিচারপতি শরীফ উদ্দিন চাকলাদার ও বিচারপতি একেএম সাহিদুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে ব্যাংক ঋণ সংক্রান্ত একটি মামলার শুনানি চলছিল। ইতোপূর্বে মামলাটির আংশিক শুনানির পর পুনরায় শুনানির দিন ধার্য ছিল।
শুনানির শুরুতেই বেঞ্চের নেতৃত্ব দানকারী সিনিয়র বিচারপতি বলেন, “এ বিষয়টি শুনানিকালে একজন মন্ত্রী আমাদের ফোন করেছিলেন। সে কারণে আমরা এই মামলার শুনানি করতে চাই না।”
আদালত এ মন্তব্য করেই যথাযথ আদেশের জন্য ফাইলসহ মামলাটি প্রধান বিচারপতিকে পাঠিয়ে দেয় ওই বেঞ্চ।
মন্ত্রীর ফোন ও বিচারপতির বিব্রতবোধের বিষয়ে একজন প্রবীণ আইনজীবী বলেন, “বিচারপতিদের বিব্রতবোধ ন্যায় বিচারেরই একটি অংশ। কোনো বিচারপতি যদি মনে করেন তিনি তার অধীনে থাকা মামলাটিতে ন্যায় বিচার করতে পারবেন না, তাহলে তিনি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী বিব্রতবোধ করে মামলাটি পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য প্রধান বিচারপতির বরাবরে পাঠিয়ে দেন। এক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।”
সোনার নৌকা :
রাজশাহীর বাঘায় গণসংবর্ধনায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের হাতে সোনার নৌকা তুলে দেন বাঘার পৌর মেয়র আক্কাস আলী। এ নিয়ে দেশজুড়ে বির্তক শুরু হলে উপহার হিসেবে পাওয়া সোনার নৌকা বিক্রি করে সেই অর্থ ‘প্রত্যাশা’ নামের স্থানীয় একটি প্রতিবন্ধী শিশু সংস্থায় দান করেন প্রতিমন্ত্রী।
প্রকাশ্যে ধূমপান করে ক্ষমা প্রার্থনা :
সিলেটের বর্ডার গার্ড পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের অনুষ্ঠানে সমাজকল্যাণমন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী মঞ্চে বসে প্রকাশ্যে ধূমপান করেন। ওই ছবিটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। এরপর মন্ত্রী তার ভুল স্বীকার করে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে জানান, অবচেতন মনেই শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি ধূমপান করে ফেলেছেন। এ ঘটনার জন্য তিনি লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
কোমলমতি শিশুরা রাস্তায় :
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পরিপত্র জারি থাকা সত্ত্বেও ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুরে জুড়ী উপজেলায় নবনির্বাচিত সরকার দলীয় হুইপ মো. শাহবুদ্দিনের সংবর্ধনায় স্কুল শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের প্রেক্ষিতেও রোববার পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি স্কুল কর্তৃপক্ষ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, শনিবার দুপুরে জুড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক মো. আজির উদ্দিনের সভাপতিত্বে নবনির্বাচিত হুইপ মো শাহাবুদ্দিনকে সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে উপজেলা সদরের জাঙ্গিরাই এলাকায় কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা সড়কে দুপুর ১টা থেকে শিশু শিক্ষা একাডেমির কোমলমতি শিশুদের দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এমনকি শিক্ষার্থীরা যেন রোদে দাঁড়াতে শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করে সেজন্য শিক্ষকরা বেত হাতে নিয়ে রাস্তার অপর পার্শ্বে দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো.শহিদুল ইসলাম উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার মাধ্যমে কারণ দর্শানোর নোটিশের কথা সাংবাদিকদের জানান। তা সত্ত্বেও রোববার পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ।
এর আগে ‘শিশুদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখে কোনো ভিআইপিকে সংবর্ধনা দেওয়া যাবে না’ এ মর্মে একটি পরিপত্র জারি করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর ব্যতিক্রম হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।
শিশুদের দাঁড় করানোর একাধিক ঘটনা ঘটে দেশের বিভিন্ন স্থানে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, “কোমলমতি ছোট ছোট বাচ্চাদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে কারো সংবর্ধনা নেওয়া কারো কাম্য হতে পারে না। আমি আশা করব, তারা আরো সচেতন হবেন।”
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এসব বিষেয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লা বলেন, “আমাদের আরো সচেতন হওয়া প্রয়োজন। আগামীতে সরকার ব্রিবত হয় এমন কিছু করা কারো উচিত হবে না।”