শরীয়তপুরে এখনও সক্রিয় আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে লিবিয়া, তুরস্ক, গ্রিস, ইতালি ও স্পেন পাঠানোর কথা বলে পাচারকারীচক্র সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। ফলে ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে যাচ্ছে অনেক পরিবারের স্বপ্ন। শোকের ছায়া নেমে এসেছে নিখোঁজ হওয়া ১৫টি পরিবারে। নিখোঁজ অনেকের পরিবার মামলা করেও পায়নি কোন সুরাহা।
নড়িয়া ও জাজিরা থানা এবং নিখোঁজ মিঠু চৌধুরীর বাবা জিতেন চৌধুরীসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী দালাল চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্যরা শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মানবপাচারকারীরা অবলীলায় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। প্রথমে নির্দিষ্ট অংকের টাকা নিয়ে মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা উন্নত ভবিষ্যতের প্রলোভন দেখিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গমনেচ্ছুদের লিবিয়া পাঠায়।
এরপর সেখান থেকে ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় করে ইউরোপের দেশ ইতালি পাঠায়। এ সময়ে ঘটে অনেক ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। ওই সকল দালালরা বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে পাশবিক নির্যাতন করে তার ভিডিও পরিবারে পাঠিয়ে স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করে লাখ লাখ টাকা। টাকা দিতে না পারলে অনেককে জীবন দিতে হয় মাফিয়াচক্রের হাতেই। পাশাপাশি লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার সময় নৌকাডুবিতে অনেকের সলিলসমাধি হচ্ছে ভূমধ্যসাগরেই। আবার অনেকেই লিবিয়া, তিউনিসিয়াসহ একাধিক দেশের কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পরে দীর্ঘদিন জেল খেটে নিঃস্ব হয়ে দেশে ফিরে আসছে। নিখোঁজদের বেশির ভাগই নড়িয়া, জাজিরা ও শরীয়তপুর সদর উপজেলার হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান।
গত ঈদুল আজহার দিন লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ঝুঁকিপূর্ণ তিনটি অবৈধ নৌকা ডুবে গেলে সেখান থেকে তানজানিয়া কোস্টগার্ডের সদস্যরা ৩১৮ জনকে উদ্ধার করে। সেখানে নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের নওগাঁও গ্রামের সেলিম কাজীর ছেলে কাজী ফিরোজ মাহমুদ (৩০) নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ কাজী ফিরোজ মাহমুদ এর সঙ্গে থাকা এসডি সুমন জানায়, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির সময় হিটস্ট্রোকে কাজী ফিরোজ মাহমুদ মারা গেছেন।
একই উপজেলার ফতেজঙ্গপুর ইউনিয়নের সিলংকর গ্রামের কৃষক লাল মিয়া ছৈয়ালের ছেলে নূহ আলম ছৈয়াল(১৯) ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হয় বলে জানান তার মামা কালাই চৌকিদার। তার সঙ্গে থাকা একই উপজেলার চামটা এলাকার শহীদ মোল্ল্যা (২০), চাকধ এলাকার আরাফাত (১৭), মোঃ শামীম হোসেন (২২), ডামুড্যা উপজেলার জাহিদ হোসেন (২৫) একই ঘটনায় নিখোঁজ। তাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
২০১৯ সালের শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মিঠু চৌধুরী, সোহেল বেপারী, জহির উদ্দিন, কবীর মিয়া, জামাল উদ্দিনসহ ১২ জন যুবক নিখোঁজ হয়। কয়েকজনের লাশ পাওয়া গেলেও বাকিদের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ মিলেনি। বিঝারী ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের জিতেন চৌধুরীর ছেলে মিঠু চৌধুরী ইতালি যাওয়ার উদ্দেশে দালালচক্রের মাধ্যমে লিবিয়া থেকে অবৈধ ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় পাড়ি দিতে গিয়ে নিখোঁজ হয় সে। এ ব্যাপারে নিখোঁজের বাবা জিতেন চৌধুরী বাদী হয়ে নড়িয়া থানায় মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য রতন খানসহ ৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করে। পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে প্রেরণ করে।
নড়িয়া উপজেলার বিঝারী ইউনিয়নের নওগাঁও এলাকার নিখোঁজ কাজী ফিরোজ মাহমুদের মা সখিনা বেগম ও নিখোঁজ নূরে আলম ছৈয়ালের মা শাহিদা বেগম বলেন, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য ফয়সাল বেপারী ও সুজন ছৈয়াল আদম ব্যবসায়ীরা আমাদের সন্তানদেরকে উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে অবৈধপথে ইতালি, গ্রিস নেয়ার কথা বলে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্নভাবে লিবিয়া নিয়ে যায়। সেখান থেকে মারধর করে প্লাস্টিকের নৌকায় উঠিয়ে সাগর পাড়ি দেয়। এতে আমাদের মতো অনেক মায়ের বুক খালি হয়েছে। এখন যারা জীবিত আছে তাদের দ্রুত উদ্ধার ও যারা মারা গেছে সে সকল সন্তানদের মরদেহ এনে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নড়িয়া সার্কেল) এসএম মিজানুর রহমান বলেন, শরীয়তপুর জেলার অনেকেই ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে থাকে। সে কারণে এ এলাকার লোকজন অনেকেই বিদেশমুখী। এ সুযোগে মানবপাচারকারী সদস্যরা প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে তাদের ফাঁদে ফেলছেন। যারা ভূমধ্যসাগরসহ বিভিন্ন দেশে গিয়ে বিপদগ্রস্ত হচ্ছেন। এবিষয়ে মামলা হওয়ার কারণে অনেকেই পলাতক রয়েছেন। আমরা তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে জোর তৎপরতা চালাচ্ছি।