দেশের প্রসিদ্ধ কওমি মাদ্রাসাগুলোর একটি মোহাম্মদপুরের জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মাদ্রাসাটি ওয়াকফ প্রশাসনে নিবন্ধিত। ওয়াকফ সম্পত্তিতে গড়ে ওঠা এই মাদ্রাসাটি ২০০১ সালে নিয়ন্ত্রণে নেয় হেফাজত নেতা মাহফুজুল হক, মামুনুল হকের পরিবার। সেই সময় থেকে মাদ্রাসাটির পরিচালনার দায়িত্ব ফিরে পেতে আইনি লড়াই চালিয়ে যায় ওয়াকফ অ্যাস্টেট পরিচালনা কমিটি। আদালতের রায়, ওয়াকফ প্রশাসনের আদেশ থাকার পরও অদৃশ্য কারণে ব্যর্থ হয় তারা।
সম্প্রতি হেফাজেতের তাণ্ডব ও মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। মাদ্রাসা ভবন ওয়াকফ প্রশাসনের অনুমোদিত কমিটির কাছে বুঝিয়ে দিতে হবে মাদ্রাসাটির বর্তমান মুহতামিম মাওলানা মাহফুজুল হককে।
জানা গেছে, রাজধানীর লালবাগের ঐতিহ্যবাহী জামি’য়া কোরআনিয়া আরাবিয়া লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন মাহফুজুল হক ও মামুনুল হকের বাবা শাইখুল হাদিস আজিজুল হক। সেই মাদ্রাসার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিবাদের জেরে ১৯৮৪ সালে লালবাগের এ মাদ্রাসাটির শিক্ষকতা ছেড়ে চলে আসেন আজিজুল হক। তার সঙ্গে সঙ্গে মাদ্রাসাটি থেকে চলে আসেন মুফতি মনসূরুল হক ও মাওলানা হিফজুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন শিক্ষক।
সেখান থেকে চলে আসার পর মোহাম্মদপুর মোহাম্মাদী হাউজিংয়ে জামিয়া মোহাম্মাদিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্ব পান মুফতি মনসূরুল হক। তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হতে অনুরোধ জানালে মাওলানা আজিজুল হক ও মাওলানা হিফজুর রহমান যোগ দেন। তবে বছর পার না হতেই মাদ্রাসাটি বন্ধ হয়ে যায়। সেখান থেকে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে মোহাম্মদপুর সাত গম্বুজ মসজিদে ভাসমান অবস্থায় মাদ্রাসা পরিচালনা করতে থাকেন তারা।
জানা গেছে, ভাসমান এই মাদ্রাসাটির জন্য সাহায্যের আবেদন করলে আলী অ্যান্ড নূর রিয়েল স্টেটের মালিক নূর হোসেন ও মোহাম্মদ আলী জমি দান করেন। তারা দশ কাঠা জমি মাদ্রাসাটির নামে ওয়াকফ করেন। ১৯৯২ সালে আরও সাড়ে ৬ কাঠা জমি তারা ওয়াকফ করেন মাদ্রাসার জন্য। জমি দান করার পাশাপাশি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের জন্য ব্যবসায়ী নূর হোসেন ও মোহাম্মদ আলী সহায়তা করেন। আরেক ব্যবসায়ী আবদুল মালেকও বড় অংকের টাকা দান করেন। ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের দানের টাকায় পাঁচ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়।
মাওলানা আবদুল গাফফার, মাওলানা আলী আসগর বিভিন্ন মেয়াদে মাদ্রাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করেন। নায়েবে মুহতামিম ছিলেন মুফতি মনসূরুল হক। মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বে আসার পর আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পান। তখন আজিজুল হকের ছোট ছেলে মাওলানা মামুনুল হক এ মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন।
হাফেজ্জী হুজুরের খেলাফত আন্দোলন থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে নামে রাজনৈতিক দল তৈরি করেন আজিজুল হক। তার ছেলেরাও এই দলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। রাজনীতিতে যুক্ত হতে মাদ্রাসাটির ছাত্রদের চাপ দিতে থাকেন তারা। মাদ্রাসাটির ছাত্র-শিক্ষকদের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের বিভিন্ন মিটিং মিছিলে নিয়ে যাওয়া হতো। মাদ্রাসার নীতি ভেঙে এভাবে রাজনীতি করায় মুফতি মনসূরুল হক, মাওলানা হিফজুর রহমানসহ অন্যান্য শিক্ষকরা এ বিষয়ে আজিজুল হককে আপত্তি জানান। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস তখন বিএনপি নেতৃত্বের জোটের শরিক দল ছিলো। বিএনপির ডাকা হরতালে ক্রমাগত মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পিকিটিংয়ে পাঠানো হতো।
এসব ঘটনায় জরুরি বৈঠক ডাকে মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি। তৎকালীন কমিটির সভাপতি আবদুল মালেকের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়, মাদ্রাসা রাজনীতি মুক্ত রাখা হবে। এরপরও রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য পরিচালনা কমিটি আজিজুল হককে মাদ্রাসার মুহতামিম পদ থেকে সরিয়ে দেয়। মুহতামিমের দায়িত্বে আসেন মাওলানা হিফজুর রহমান। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় আজিজুল হকের ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হকসহ ৪-৫ জন শিক্ষককে মাদ্রাসা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে অব্যাহতি নেন মাওলানা আজিজুল হক।
দৃশ্যপট বদলে যায় ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসার পর। তৎকালীন সংসদ সদস্য মুফতি শহিদুল ইসলামের সহযোগিতায় নভেম্বরে মাদ্রাসাটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন আজিজুল হক। মাদ্রাসায় দায়িত্ব পান তার চার ছেলে হাফেজ মাহমুদুল হক, হাফেজ মাহবুবুল হক, মাওলানা মাহফুজুল হক ও মাওলানা মামুনুল হক। পরবর্তীতে তাদের পরিবারের সদস্যরাই মাদ্রাসাটিতে শিক্ষকতা ও অন্যান্য দায়িত্বে প্রাধান্য পেয়েছেন। আজিজুল হক বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নেতা হওয়ায় থানায় অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাননি তৎকালীন কমিটি ও শিক্ষকরা। আদালতে গেলেও অদৃশ্য কারণে দীর্ঘসূত্রতায় আটকে থাকে বিচার প্রক্রিয়া।
সে সময়ে ৩৫ জন শিক্ষককে মোহাম্মদপুরের জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবে তৎকালীন পরিচালনা কমিটির সহায়তায় মাদ্রাসাটির পাশেই একটি জায়গা ভাড়া নিয়ে জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া নামেই মাদ্রাসা পরিচালনা শুরু করেন মুফতি মনসূরুল হক। একইসঙ্গে মাদ্রাসাটির পরিচালনা কমিটি দখল হয়ে যাওয়া ভবন উদ্ধারে আইনগত লড়াই চালিয়ে যান।
শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হক মাদ্রাসাটি পরিচালনা করেন। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে তার ছেলে মাওলানা মাহফুজুল হক মাদ্রাসাটির মুহতামিম হিসেবে দায়িত্বে পালন করছেন। এদিকে, মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটি এনিয়ে আদালতের শরণাপন্ন হলে, তাদের পক্ষে রায়ও হয়। রায় হলেও মাদ্রাসাটির দায়িত্ব ফিরে পাননি সেই শিক্ষকরা। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডের পর বিষয়টি আবারও আলোচনায় আসে। এরপর স্থানীয় প্রশাসন মাহফুজুল হককে মাদ্রাসা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেয়।
সর্বশেষ ১৮ মে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসা ওয়াকফ অ্যাস্টেট পরিচালনার জন্য ২১ সদস্যের একটি পরিচালনা কমিটি অনুমোদন দেয়। তিন বছরের জন্য এই কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই কমিটির সভাপতি আব্দুর রহীম। কমিটির সহ-সভাপতি হারুনুর রশীদ, আলীমুজ্জামান, সম্পাদক কাজী সাহিদুর রহমান, অর্থ সম্পাদক হাফিয আব্দুল গাফফার, রঈস মাওলানা হিফজুর রহমান, শাইখ মুফতি মনসুরুল হক। কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন ক্বারী মুজাফ্ফর হুসাইন, ডা. আব্দুল কাইউম, মুজাম্মেল হুসাইন, আকরাম হুসাইন, উমর ফারুক মিল্কী, মুনীর সাঈদ, আলী হুসাইন, ডা. আহসানুল্লাহ, ডা. ইখলাসুর রহমান, আব্দুল হালীম, আব্দুর রব, হিফজুল বারী।
গত ২৯ জুন বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন জামি’আ রাহমানিয়া আরাবিয়া সাত মসজিদ মাদ্রাসা ওয়াকফ অ্যাস্টেট’র সম্পত্তি অনুমোদিত কমিটির কাছে বুঝিয়ে দিতে ঢাকা জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়।
এদিকে মাদ্রাসাটির হস্তান্তরের গুঞ্জনে মাদ্রাসা এলাকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) হুট করেই গুঞ্জন ওঠে মাদ্রাসা ছেড়ে দিচ্ছেন মাহফুজুল হক। এ গুঞ্জনে মুফতি মনসূরুল হকের অনুসারীরাও জড়ো হতে থাকেন। পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হওয়ার শঙ্কায় আসে পুলিশ। যদিও শেষ পর্যন্ত কিছু হয়নি।
ওয়াকফ প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে জানতে যোগাযোগ করলে ঢাকা জেলা প্রশাসক মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে জেলা প্রশাসকের স্টাফ অফিসার ও সহকারী কমিশনার মো. আব্দুল হালিম জানান, এ বিষয়ে বাংলাদেশ ওয়াকফ প্রশাসন ভালো বলতে পারবে।
এ বিষয়ে মুফতি মনসূরুল হক বলেন, ওয়াকফ প্রশাসন কর্তৃক একটি অনুমোদিত কমিটি আছে। সেই কমিটি মাদ্রাসারার সম্পত্তি ফেরত পাবার জন্য আইনি লড়াই করছে। দখলমুক্ত করে কমিটির কাছে হস্তান্তর করা প্রশাসনের দায়িত্ব। আমার নিজে থেকে কোন ধরণের সংঘাত, বিরোধ, উচ্ছেদে যাইনি, যাবো না।
তবে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে চান না মাওলানা মাহফুজুল হক। তিনি বলেন, সময় হলে আমি সব বলবো।