মো.সাইফুল ইসলাম
সিলেটের সাহিত্যাকাশে কামাল তৈয়ব একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র।শব্দের প্রতিভাবান এই কারিগর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৯৬৬সনে মাতৃমঙ্গলে জন্মগ্রহণ করেন,তখন দরগাগেটে বসবাস করতেন।বহুদিন ধরে গুণী এই কাব্যকর্তাকে নিয়ে দু’কলম লেখার তৃষ্ণা নিবারণে আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
কবিতায় তার শব্দ প্রয়োগ সচরাচর কবিদের মতন নয়,শব্দ প্রয়োগে রয়েছে তার নিজস্ব ক্যাটাগরিতে গভীর প্রতিভা।
তার কাব্যে উপমায়,উৎপ্রেক্ষাও অনুপ্রাসে পাঠকমাত্রই চমকে দেয়,কবিতা হয়ে থাকে তার সময়োপযোগীও দীর্ঘজীবী।
এই মানুষটির সাথে পরিচয় ২০১২সালের কোন একদিন কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ (কেমুসাস)এর কোন এক সাপ্তাহিক সাহিত্য আসরে।তখন সাহিত্য আসর পরিচালনা করতেন
কবিবন্ধু গোলাম ইউসুফ সাগর (বর্তমানে ঢাকায় একটি জাতীয় পত্রিকায় কর্মরত)।সেই সাহিত্য আসর হতে কামাল তৈয়ব এর প্রতি আমার ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা।সর্বশেষ,সাক্ষাৎ সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে,একদিন উনার বাসায় গেলাম-বহুদিন পরে দেখা পেয়ে আমি যখন আন্দোলিত তিনি তখন আমি ক্ষুদ্র মানুষকে আন্তরিক সহযোগিতা আর আপ্যায়নে ব্যস্ত।কিন্তু কোর্টের গাদা গাদা ফাইল তার টেবিলে-এসব দেখে
কবিতা হতে তার দূরে চলে যাওয়ার এই প্রবণতা আমার মন ক্ষুন্ন করে।যদিও একজন অ্যাডভোকেট হিসেবেও আইন পেশায় তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ আইনজীবী।
গুরু সমতুল্য ভেবে আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি ।
একটি সময় ডাস্টারে চকে হাত ধরে কেমুসাসে শব্দের ক্লাস নিতেন এই শব্দগুরু।তার অসম্ভব কাব্য প্রতিভা অমর কব্য ভান্ডার জাতিকে উপহার দিতে পারতো।আমাদের মতন তরুণ লেখিয়েরা তার মতন গুণী শব্দগুরু’র সংস্পর্শে শিখতে পারতো নতুন নতুন কাব্য ধারা।আজ সেই আশা আর তেমন করা যায়না।অবশ্য একেবারে নিরাশ হবারও কিছু নেই।মাঝে মধ্যে সে নেশায় তাকে ডুবতে দেখা যায় এখন।
তবে এই প্রজন্মের অনেকেই কামাল তৈয়ব সম্পর্কে তেমন ধারণা রাখেনা,এটা সত্য।এর কারণ তিনি আইনের প্যাঁচে বন্ধী হয়ে নিজেকে অসার তৃপ্তি মেটাতে মগ্ন।কিন্তু আমি নিশ্চিত-তার কাব্যসত্ত্বা এ নিয়ে বিলাপ করছে হৃদয়কোণে ,তৃষ্ণা মিটেও মিটছে না।রবীন্দ্রনাথের “শেষ হইয়াও হইলনা শেষ” এর মতোই তার একটা অতৃপ্তি-ই কাজ করছে কবিসত্তার মনের গহীনে।
আমি অতি নগণ্য।কবিতায় কামাল তৈয়ব Kamal Tayeb এর ছাত্রতুল্য।তার শব্দশৈলীও কাব্য প্রতিভা নিয়ে বিচার বিবেচনা কিংবা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এর কোনটিরই আমি যোগ্য নই।তারপরও ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা।দু’কলম এখানে ফূটাতে চাই অগোছালো হলেও।
কয়েক বছর আগে কেমুসাসে কালেমা লেপন করে একটি সন্ত্রাসী চক্র।কেমুসাসের দরজা,জানালাও দেয়াল কাঁচের মতন চুর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যায়।সিলেটের কবি সাহিত্যিক ও সাংবাদিকগণ এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান।কিন্তু কেউ এর প্রতিবাদের ভাষা এ-তো সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে পারেননি,যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন কবি কামাল তৈয়ব।তার স্বরচিত “একদলা থুতু” কবিতাটি সেই সময় ছিল প্রতিবাদের শ্রেষ্ঠ ভাষাও সেরা কবিতা হিসেবে সর্ব মহলে ছিলো প্রশংসিত।
কবিতায় কামাল তৈয়ব এর শব্দ প্রয়োগ সচরাচর কবিদের এড়িয়ে নিজস্ব ধাঁচ সৃষ্টি করেছে। তার “শ্লাঘাপদ” কবিতায় শব্দের প্রয়োগ যেন এক নিপুণ সৃষ্টি।কবি কবি ডাক যেন তাকে অতিষ্ট করে তুলেছে-
“যদি ডাকতেই হয় তবে কবি নয়
অন্য কোনো নামে ডেকো
কবির কথা ভাবলেই কয়েকটা গিরগিটি রক্তিম ঘাড় বাঁকিয়ে সবুজ হয়ে যায়
আলোর নিচে শিকারী হয়ে উঠে পোকাখেকো কতোগুলো ফ্যাকাসে টিকটিকি
দোহাই তোমাদের! আর কবি বলে নয়
যদি ডাকতেই হয় তবে ডেকো অন্য কোনো নামে।”
এখানে এ-তো সুন্দর শব্দের গাঁথুনি,যেকোনো পাঠককে মুগ্ধ করবে। কবি শব্দটি শুনে এখানে গিরগিটি গুলো কীভাবে তাদের চেহারা পাল্টে দেয়-তা তিনি বাস্তব চক্ষু দিয়ে উপলব্ধি করেছেন।
তাই কবি বলে না ডাকার জন্য তিনি তার পাঠক ও শুভাকাঙ্খীদের অনুরোধ করেছেন।
আর শিকারী আলো দেখলে কতটা ফ্যাকাসে রূপ ধারণ করে অর্থাৎ কবির কাব্যশৈলী বা শব্দশৈলী তথা-কবিতায় শব্দের প্রয়োগ দেখলে নাক তাদের কপালে উঠে,পোকা বলে এখানে তিনি নিজেকে ক্ষুদ্র হিসেবেই দারুণ উপমায় প্রকাশ করেছেন।যা অন্য কোন কবির কবিতায় আমি দেখিনি।
এই কবিতার পরের শ্লোকগুলা আরো দারুণ, আরো চমৎকার।যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়।
“কার্তিকের শেষ প্রত্যুষে” কবিতাটি ও চমৎকার শব্দ,উপমা,উৎপ্রেক্ষা ও অনুপ্রাসে মুড়ানো।যেমন-
শিশির ভেজাঁ কোন এক ভোরে ট্রেন চলেছে প্রচন্ড শৈত্যপ্রবাহর গহীন ভিতর দিয়ে-
“হুশেল বাজিয়ে ট্রেন দ্রুতবেগে ধেয়ে গেলো হিম কুয়াশায়
হুঁকোয় দু’দম নিয়ে তারো আগে চলে আসে মাঠের নায়ক
দু’ধারে তুহীন ছোঁয়া সবুজ ‘শালি’র গায়ে শিশির ঝরায়
মুহূর্তেই আমাদের লোমকণা কাঁটা দিয়ে সুতীক্ষ শায়ক।”
এখানে এই কবিতায় যেন জীবনানন্দের সুগন্ধি ছড়াচ্ছে,এমনটা আমার মনে হয়।এ যেন আধুনিকোত্তোর যুগের জীবনানন্দ।কামাল তৈয়ব এর কবিতার ঘ্রাণ ব্যাকুল করে তুলে আমাকে,আমার মতন সহস্র পাঠককে।তার এক একটি কবিতা এক একটি হিমালয়।কাব্যে তার
শব্দের গাঁথুনি বর্তমানে ঢাকার অনেক কবির পক্ষেও এমনটা দেখা যায়না।ঢাকায় থাকলে কামাল তৈয়ব ব্রান্ড হতেন সারা বাংলার জন্য।
তিনি অন্যান্য মানুষের মতন মোচড় খেয়েছেন হয়তো বার বার।তাইতো ” মোচড়” কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“বাতাস হে! জনপদ বাসিন্দা যদি জল বলে
ভ্রম করে ফেলে
তোমার তাতে কী ক্ষতি
আমাদেরই হাঁটাচরা বদলাবে সাঁতারে সাঁতারে….
জলঘোলা করে রাখি যন্ত্রনার ক্ষত দাগ
ধরে।”
বাতাসে যেন তিনি সমস্ত গ্লানি মুছে নিজেকে বদলে দিতে চান,আবার নতুন করে আবিষ্কার করতে চান আপন বলয়ে ।গ্লানি মুছে ফের ঝরঝরে সতেজ হয়ে যেতে চান কবি।
প্রিয় পাঠক,তারিখ করতে করতে আজ হঠাৎ করেই তৃষ্ণা নিবারণের জন্য খুব স্বল্প পরিসরে কামাল তৈয়ব এর কবিতায় শব্দ প্রয়োগ ও তার কাব্য প্রতিভার কিঞ্চিৎ পরিমাণ তুলে ধরার অপচেষ্টা করেছি মাত্র।গোটা আলোচনায় মাত্র একবার কবি শব্দটি ব্যবহার করেছি,যেহেতু তিনি তা বলতে বারণ করেছেন।আর যারা কাজের কাজী তারা মূলত নামের চেয়ে কাজকেই প্রাধান্য দেন বেশি।যেমনটা দিয়েছেন কামাল তৈয়ব।এই শব্দশিল্পীকে ভালো করে জানতে হলে মনযোগসহকারে তার কবিতাসমূহ পাঠ করা প্রয়োজন।যদিও এখন পর্যন্ত তিনি কোন কবিতার বই বের করেননি।আমাদের অনুরোধ তার কাছে,তিনি যেন অন্তত একটি বই বের করে আমাদের উপকৃত করেন।পরিশেষে,শব্দগুরু কামাল তৈয়ব এর সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।আল্লাহ হাফেজ।
London Bangla A Force for the community…
