রুদ্র মিজান
এক তরুণীকে জোর করে, খাটে শুইয়ে মুখ চেপে ধরেছে কয়েকজন। তার পরনে জামা নেই। খোলার চেষ্টা করা হচ্ছে কালো অন্তর্বাস, জিন্সপ্যান্টও। তরুণী আপ্রাণ চেষ্টা করছেন নিজেকে রক্ষা করতে। মুখচেপে ধরা একজোড়া হাত সরাচ্ছেন বারবার। ‘মাগো মাগো’ বলে চিৎকার করছেন। এরমধ্যে নির্যাতনকারী দলের এক তরুণী জোর করে শরীরের স্বল্প বস্ত্রটুকু খুলে নেয়। তারপর যা ঘটেছে তা বর্ণনা করার মতো না।
সকল অসভ্যতাকে হার মানিয়েছে এই যৌন নির্যাতন। দুই মিনিট বায়ান্ন সেকেন্ডের ভিডিও। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর নজরে পড়ে পুলিশের। শুরু হয় তদন্ত। পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, লোমহর্ষক এই যৌন নির্যাতনের ঘটনাটি ভারতের কেরালায় ঘটলেও নির্যাতনের শিকার মেয়েটি বাংলাদেশি। এমনকি নির্যাতনকারী দলের এক সদস্যও ঢাকার। ওই ভিডিও এবং ফেসবুকের ছবি দেখেই শনাক্ত করা হয় যৌন নির্যাতনকারীদের একজনকে। ছাব্বিশ বছর বয়সী ওই তরুণের নাম রিফাজুল ইসলাম হৃদয় (২৬)। টিকটক ভিডিও করার কারণে রাজধানীর মগবাজার, হাতিরঝিল এলাকার লোকজন ও পরিচিত জনরা তাকে ‘টিকটক হৃদয় বাবু’ নামেই চিনেন। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্যাতিতার মাথার পাশে বসে যে দু’হাত চেপে ধরেছিলো সেই ছেলেটিই এই টিকটক হৃদয় ওরফে রিদয়। এ ঘটনায় গতকাল হাতিরঝিল থানায় মামলা করেছেন নির্যাতিতার পিতা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, হৃদয় একটি নারী পাচারকারী চক্রের সদস্য। দেশ থেকে অসহায় নারীদের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যায়। সেখানে বিক্রি করে দেয়া হয়। জোর করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রাথমিক তথ্য পেয়েছে পুলিশ। হৃদয়ের মামা ফরহাদ হোসেন জানান, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হৃদয় লেখাপড়া না করেই বখাটে হয়ে গিয়েছিল। এসব কারণে গত চার মাস আগে হৃদয়কে বাড়ি থেকে বের করে দেন তার মা। ধারণা করা হচ্ছে, বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার কিছুদিন পরেই হৃদয় ভারতে চলে যায়। সেখানে কোনো একটি ক্রাইম গ্যাংয়ের সঙ্গে আগে থেকেই জড়িত রয়েছে সে। যে মেয়েকে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে ওই মেয়ের বাসা ও হৃদয়ের বাসা ঢাকার মগবাজার এলাকায়। তারা পূর্বপরিচিত। হৃদয় বাড়ি ছাড়া হওয়ার প্রায় দেড় বছর আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হন নির্যাতিতা।
জানা গেছে, নির্যাতিতা তরুণীর বাড়ি কিশোরগঞ্জে। মা-বাবার সঙ্গে ঢাকার মগবাজার এলাকায় থাকতেন। বাবা ক্ষুদে ব্যবসায়ী। অভাব অনটনের সংসার। ২০১৪ সালে কুয়েত প্রবাসী দিদার নামে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের এক যুবককে ভালোবেসে বিয়ে করেন তিনি। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ির লোকদের ‘নির্যাতনের’ কারণে বাবার বাড়িতেই থাকতেন। ওই তরুণীর চার বছর বয়সী এক পুত্র সন্তান রয়েছে। বাবার আর্থিক অনটনের কথা চিন্তা করে সৌদি আরব যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে দালাল অর্থ আত্মসাৎ করার কারণে আর সেখানে যাওয়া হয়নি। এই অবস্থায় ২০১৯ সালে হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যান ওই তরুণী। তারপর আর খোঁজ মিলেনি। তবে অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বেশ কিছুদিন দুবাইয়ে ছিলেন তিনি। পরে দুবাই থেকে চলে যান ভারতে। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না তার। এরমধ্যেই ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা গেছে তাকে। তবে এখনো ওই তরুণীকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার মো. হাফিজ আল ফারুক জানান, সাইবার পেট্রোলিং করতে গিয়ে ভিডিওটি পুলিশের নজরে আসে। ইতিমধ্যে ভিকটিম ও নির্যাতনকারী হৃদয়কে শনাক্ত করা হয়েছে। এতে জড়িত অন্যদেরও শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
পুলিশের ধারণা ওই তরুণীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল টিকটক হৃদয়ের। দু’জনই ভারতের কেরালায় একসঙ্গে ছিল। হৃদয়ের অবস্থান সম্পর্কে জানতে তার মামা-চাচার সহযোগিতা নিয়েছে পুলিশ। হোয়াটসঅ্যাপে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করে হৃদয়ের স্বজনরা জানান, হৃদয় বর্তমানে ভারতের পুনেতে অবস্থান করছে। ভাইরাল হওয়া ভিডিও’র ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় ২০-২৫ দিন আগে কেরালায়। ভিডিওতে দেখা যাওয়া যুবকটি হৃদয় নিজে বলে স্বীকার করেছে তার মামার কাছে। তবে কি কারণে যৌন নির্যাতনের এই ঘটনা ঘটেছে তা জানা যায়নি। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, টিকটক করার মাধ্যমে পরিচিতি গড়ে উঠেছিলো হৃদয়ের। টিকটক ভিডিও তৈরি ও সময়ে-অসময়ে আড্ডা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সে। হাতিরঝিল এলাকায় রয়েছে হৃদয় বাবুর একটি গ্যাং। যার বেশির ভাগ সদস্য কিশোর। জিক্সার, পালসার, ফিজারসহ নানা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল নিয়ে বিকাল থেকে রাত অবধি হাতিরঝিল, মগবাজার এলাকায় আড্ডা দেয় এই গ্রুপ। বিকট শব্দে বাইক চালানো, মেয়েদের উত্ত্যক্ত করা থেকে শুরু করে মাদকের নেশায়ও জড়িত এই গ্যাংয়ের সদস্যরা। মাদক সেবন ও বিক্রি করতো তারা। এই গ্রুপে রয়েছে বেশ কয়েক নারী সদস্যও। ছিনতাই-ডাকাতির ঘটনাও ঘটিয়েছে এই ‘হৃদয় বাবু গ্যাং’। ২০১৪ সালে একটি ডাকাতির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রমনা থানায় একটি মামলা হয় হৃদয়সহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে।
মগবাজার নয়াটোলার লায়ন্স মডেল স্কুল থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে রিফাজুল ইসলাম হৃদয়। যদিও তার ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছে বলে তথ্য দেয়া রয়েছে।
এসব বিষয়ে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, হৃদয় একটি চক্রের সদস্য। এই চক্রটি প্রেমের ফাঁদে ফেলে অসহায় ও বিদেশ গমনে ইচ্ছুক মেয়েদের প্রলুব্ধ করে বিদেশে পাচার করে। ইন্টারপোল ও ভারতের পুলিশের সহযোগিতায় এই ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার ও ভিকটিমকে উদ্ধার করা হবে বলে জানান তিনি। এ ঘটনায় জড়িত রিফাজুল ইসলাম হৃদয় (২৬) রাজধানীর হাতিরঝিল থানার ৫২৭/৬, নয়াটোলা, বৌ-বাজারের আবুল হোসেনের পুত্র।
সৌজন্যে মানবজমিন