দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কা সরকারকে ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিয়োগের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি সোয়াপের আওতায় এই ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে। এর জন্য ২ শতাংশ সুদ পাবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে গত সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্ষদসভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। শ্রীলঙ্কা সরকার ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে তা হবে কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কারেন্সি সোয়াপের প্রথম ঘটনা। সেই সঙ্গে এটি হবে বাংলাদেশের জন্য একটি বড় অর্জন। রিজার্ভ থেকে প্রথমবার কোনো দেশকে ঋণ দেওয়ার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন দেশের অর্থনীতিবিদরাও। তবে সোয়াপ পদ্ধতির এই বিনিয়োগে কারেন্সির ওঠানামায় বাংলাদেশের যেন কোনো লোকসান না হয় সে বিষয়টিতে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘রিজার্ভ থেকে শ্রীলঙ্কাকে ২০ কোটি ডলারের ঋণ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২ শতাংশ সুদে এটা দেওয়া হবে। এখন এটি নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আরো আলোচনা হবে। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। আবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সদস্যও। তাই রিজার্ভ থেকে তাদের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করা যেতেই পারে। তা ছাড়া আমাদের রিজার্ভের পরিমাণও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি আছে।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ দেশটি বাংলাদেশ থেকে ডলার নেবে তাদের নিজস্ব কারেন্সি দিয়ে। আবার এর বিপরীতে ২ শতাংশ সুদও দেবে। তাই এটা আমাদের জন্য ইতিবাচক। কারণ এখন ২ শতাংশ সুদ পাওয়া বড় ব্যাপার। কিন্তু দেশটি সোয়াপ করে ডলার নেওয়ার পর পরবর্তী সময়ে সেটা কিভাবে ফেরত দেবে তা স্পষ্ট হওয়া দরকার। শ্রীলঙ্কা যদি ডলার নিয়ে সমপরিমাণ কারেন্সি দিয়ে থাকে, তাহলে অর্থ দাঁড়ায়- বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের কাছে ডলার বিক্রি করল। এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কান রুপি মান হারালে বাংলাদেশের লোকসানের আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে লোকসান এড়াতে শ্রীলঙ্কান রুপি দ্রুত ব্যবহার করা লাগতে পারে। তাই বাংলাদেশ ব্যাংককে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা ২০ কোটি ডলার যেটা দেওয়া হবে, সেটা বিক্রি বা ধার যেভাবেই দেওয়া হোক কোনো ক্রমেই রিয়েল টার্মে যেন আমাদের লোকসান না হয়।’
সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকে অতি দুর্বল দেশের পাশে দাঁড়ানোর অংশ হিসেবে কারেন্সি সোয়াপ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে। বর্তমানে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ৪০০ কোটি ডলার। এই রিজার্ভ দিয়ে তাদের তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, রিজার্ভকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে কমপক্ষে তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান বৈদেশিক মুদ্রা রাখতে হয়। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ করে রিজার্ভ বাড়াতে চায় শ্রীলঙ্কা। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার দিক থেকে অনেকটা শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ চার হাজার ৫০০ কোটি ডলার (৪৫ বিলিয়ন), যা দিয়ে কমপক্ষে ১০ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এ ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় রিজার্ভের দিক থেকে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠান উপলক্ষে মার্চে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরও ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময়ে তাঁরা এ বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি প্রস্তাব দেন। এতে তিনি সম্মত হলে পরে শ্রীলঙ্কায় ফিরে গিয়ে তাঁরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠান। এর আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পর্ষদ ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জানা যায়, এই ঋণের জন্য ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লাইবরের (লন্ডন আন্ত ব্যাংক সুদের হার) সঙ্গে অতিরিক্ত ২ শতাংশ সুদ যুক্ত করে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে পরিশোধ করবে। তিন মাসের বেশি সময়ের জন্য দিতে হবে লাইবরের সঙ্গে অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ সুদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিয়োগের বিপরীতে গ্যারান্টি দেবে শ্রীলঙ্কার সরকার ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ২০ কোটি ডলার সমমূল্যের শ্রীলঙ্কান রুপি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে লিয়েন হিসেবে জমা দেবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নাজুক পরিস্থিতি কাটাতে অনেক আগে থেকে ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ করে আসছে শ্রীলঙ্কা। এ মুহূর্তে ভারতের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কারেন্সি সোয়াপের পরিমাণ ৪০ কোটি ডলার। চুক্তি অনুযায়ী ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত এই কারেন্সি সোয়াপের মেয়াদ রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি কারেন্সি সোয়াপ রয়েছে চীনের সঙ্গে। গত মার্চে চীনের সঙ্গে দেড় বিলিয়ন ডলার বা ১০ বিলিয়ন চায়নিজ ইয়েন সোয়াপ করার চুক্তি হয়েছে।