নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির সামনে এখন অন্ধকার বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এশিয়ার গণতন্ত্র বিপদের সম্মুখীন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, নির্বাচন-পরবর্তী বাংলাদেশ এখন অন্ধকার রাজনৈতিক গহ্বরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এএফপি সোমবার বলেছে, বিরোধী দলবর্জিত রক্তক্ষয়ী সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিজয় দাবি করেছে। বিরোধী দল বর্জন করায় রোববারের নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনো সংশয় ছিল না। নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাসীন দল বা এর সহযোগীরা ৩০০ আসনের পার্লামেন্টের ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছে। বাকি ১৪৭টি আসনের মধ্যে আটটি বাদে সব ক’টিরই ফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০৫টি আসনেই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করেছে। আর বাকি ৩৪টি আসনে এর সহযোগী দল বা স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়লাভ করেছেন। তবে নির্বাচনের দিনের সহিংসতায় কমপক্ষে ১৮ জনের মৃত্যু, নির্বাচনবিরোধীদের শত শত ভোট কেন্দ্রে আগুন দেয়ার ঘটনা ১৯৭১ সালে যে চেতনায় দেশ স্বাধীন হয়েছিল সেটাকেই খাটো করেছে। বাংলাদেশে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে সোমবার সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। ‘ডেমোক্রেসি ইন পেরিল ইন এশিয়া’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, এশিয়ার তিন দেশ কম্বোডিয়া, বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের রাজপথের বিক্ষোভই অনেক উন্নয়নশীল দেশের ভঙ্গুর গণতন্ত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশাপাশি কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডের গণতান্ত্রিক অবস্থার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই তিনটি দেশের সঙ্কটের কারণ দৃশ্যত আলাদা হলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু বিষয়ের সামঞ্জস্য রয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব, নির্বাচনে তিন দেশেই আস্থাহীনতা অস্থিরতা সৃষ্টির অন্যতম কারণ। স্বেচ্ছাচার এবং দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদরা সরকারি সংস্থাকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে দশকের পর দশক ধরে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কাজে লাগাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল রোববার অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করেছে। এর কারণ হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল এ নির্বাচন বর্জন করেছে। নির্বাচন আয়োজন করতে বিরোধী দল বিএনপির নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেনে না নেয়ায় নির্বাচন-পূর্ব কয়েক সপ্তাহের সহিংসতায় ১০০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ১৯৯১ সাল থেকে শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দেশ শাসনের দায়িত্ব পালন করেছেন। দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করলেও শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া নিজেদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় দেশের স্থিতিশীলতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। দেশের বিচার ব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠানকে দৃঢ় করতে দুই নেত্রী খুব কমই ভূমিকা পালন করেছেন। এতে আরও বলা হয়েছে, এ ধরনের সমস্যা থেকে দ্রুত পরিত্রাণ পাওয়া সহজ নয়। এক্ষেত্রে নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হলেও স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সেটা যথেষ্ট নয়। এসব দেশে রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহি করার মতো উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সক্ষম না হলে সেখানে জনঅসন্তোষের ভয়াবহ ঝুঁকি রয়েই যাবে। জার্মানির ডয়েচে ভেলে ‘সব দলের অংশগ্রহণে আরেকটি নির্বাচন প্রয়োজন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছেÑ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিলের দাবিতে সোমবার সকাল থেকে সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল ডেকেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী ১৮ দল। আর নির্বাচন সফল করায় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে সুশীল সমাজ ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখন সব দলের অংশগ্রহণে যত দ্রুত আরেকটি নির্বাচন হয় ততই মঙ্গল, নয়তো এ সঙ্কট আরও বাড়বে। বিবিসি সোমবার ‘আওয়ামী লীগের পাশেই থাকবে ভারত : ভারতীয় বিশ্লেষকরা’ শিরোনামে এক রিপোর্টে বলেছে, সহিংসতার মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে বাংলাদেশের বিতর্কিত নির্বাচন। বাংলাদেশে আজকের নির্বাচনের দিকে সতর্ক নজর রাখলেও প্রতিবেশী ভারতের পক্ষ থেকে সরকারিভাবে এ নির্বাচন নিয়ে এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। তবে ভারতের কূটনৈতিক মহল ও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিতর্কিত হলেও এ নির্বাচন যে কোনো মতেই অসাংবিধানিক নয়, ভারত সেটা স্বীকার করে এবং তাই এই নির্বাচনের প্রশ্নে তারা ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারের পাশেই আছে। ভয়েস অব আমেরিকা (ভিওএ) ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের ফলাফলে বিরোধী দল নিরুত্তাপ’ শিরোনামে লিখেছে বাংলাদেশের সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে। বিরোধী দল এ নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় ফল অনেকটা অবধারিতই ছিল। তবে নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে দেশে আরও সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে আরও বলা হয়েছে, এটি ছিল এমনই নির্বাচন যেখানে ভোট গণনার কোনো বিষয় ছিল না। কারণ অর্ধেকের বেশি আসনেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে। নির্বাচন বর্জন করা বিরোধী দল এ নির্বাচনকে প্রহসন বলে উল্লেখ করে সরকারের প্রতি এ নির্বাচন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘একতরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় : নিহত ২১, ২০০ নির্বাচন কেন্দ্রে আগুন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত রোববারের সাধারণ নির্বাচনে ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী দলের বর্জনের কারণে এ নির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল বেশ কম। নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় কমপক্ষে ২১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সহিংসতার ভয়ে বেশিরভাগ ভোটারই বাড়ি থেকে বের হননি বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।