কারো নির্দেশনার অপেক্ষায় না থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে এবং নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ শনিবার লন্ডন থেকে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় তারেক রহমান এই আহ্বান জানান। লন্ডন সময় বিকেলে তিনি এই বার্তা রেকর্ড করেন।
বার্তায় তারেক রহমান বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, আইনশৃংখলা বাহিনীর হাতে বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের প্রানহানি, বিরোধীদলের নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি, নির্বাচন বন্ধসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারেক রহমানের পুরো বক্তব্যটি হুবহু তুলে ধরা হলো ।
প্রিয় দেশবাসী, আসসালামু আলাইকুম।
আমাদের দেশ যখন আজ এক গভীর অনিশ্চয়তায় নিমজ্জিত, তখন ‘আপনারা ভালো আছেন’ এই প্রত্যাশা যেন নিছকই এক আনুষ্ঠানিকতা। মত প্রকাশে সরকারী হস্তক্ষেপ, হয়রানি, দমন-পীড়ন এবং জনমনে সর্বোপরি অশান্তি আজ এমন এক মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে যে, আমি আশংকা করি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই হয়তো আজ আর আন্তরিকভাবে বলতে পারেন না যে – আমরা ভালো আছি।
প্রিয় দেশবাসী, নানান পালাবদল থাকলেও রাজনীতি হচ্ছে মৌলিক ভাবে মানুষ কেন্দ্রিক। আমি, আপনি, আপনারা – আমাদের সকলেরই রাজনৈতিক বিশ্বাস আছে। রাজনীতিতে আমরা হয়তো কেউ সরাসরি যুক্ত, বা কেউ কোন সংগঠন বা আদর্শকে সমর্থন করি। আমাদের সবারই নিজেদের মত করে রাজনৈতিক মতামত আছে। হতে পারে সেই মতামত গুলো ভিন্ন-ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে আমাদের সবার মাঝে যে মিলটি রয়েছে, তা হচ্ছে আমাদের চিন্তা ও চেতনায় রয়েছে এই দেশ, এই দেশের মানুষ। দেশের কল্যাণের উপায় নিয়ে আমাদের নিজেদের মাঝে ভিন্নমত থাকতেই পারে। কিন্তু দেশের অস্তিত্ব নিয়ে কোন ভিন্নমত থাকতে পারে না।
আজ অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি, চলমান রাজনীতিতে যেন দেশের এই অস্তিত্বকে ঘিরেই বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর সার্বভৌমত্বের যে সংজ্ঞা আমরা চিরকাল জেনেছি, ক্ষুদ্র একটি রাজনৈতিক জনসমষ্টি নিজেদের স্বার্থে আজ সেই সংজ্ঞাকে বদলে ফেলছে। প্রতিবেশি যে রাষ্ট্রের সাথে আমাদের সম্পর্ক হতে পারে স্বাভাবিক, ভিত্তি হতে পারে পারষ্পরিক মঙ্গল ও সমঝোতা, সেই সম্পর্ককে ব্যাক্তিগত ও সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করে সেই রাজনৈতিক জনসমষ্টি আজ জনমতকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাচ্ছে। গণতন্ত্রের পালাবদলেই এক সময়ে আজকের এই জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়েছিল। ক্ষমতায় যাওয়ার সেই প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা সেই প্রক্রিয়াকে মেনে নিয়ে বিরোধী দলে গিয়েছিলাম। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশের সম্পদের অভূতপূর্ব লুটপাট, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বর ন্যাক্কারজনক বিনাশ, আর রাজনৈতিক-বিরোধী ও সমালোচকদের নজিরবিহীন দমনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে, তাদের ক্ষমতা লাভের সেই প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষেই কলংকজনক ছিল।
বাংলাদেশ জুড়ে আজ চলছে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট। জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগের উপর বিুদ্ধ হয়ে আছে দেশের মানুষ। জনসমর্থন ও আত্মবিশ্বাস শূণ্যের কোঁটায় পৌছানো আওয়ামী লীগ সরকার গণমানুষের ইচ্ছাকে তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা, রাজনৈতিক গুম-খুন, সাংবাদিক নির্যাতন ও হত্যা, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি, ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের গণহত্যা, আর দুর্নীতির স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সব অভিযোগের মুখে মানুষ প্রতিটি পদে-পদে এ সরকারের উপর অনাস্থার কথা জানিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত স্থানীয় নির্বাচনগুলোয় প্রতিকুল পরিস্থিতিতেও বিএনপি প্রার্থীদের ব্যাপক বিজয়ের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষ আওয়ামী লীগ এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অবস্থান – দু’টোকেই দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
এর ফলে সৃষ্ট অচলাবস্থায় মানুষের মনে স্বাভাবিকভাবেই আজ কয়েকটি প্রশ্ন উঠে এসেছে। নির্বাচনকালীন যে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার দাবিতে আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করেছিল, ৬ জন সাধারণ মানুষকে নিহত হতে হয়েছিল, সেই ব্যবস্থার প্রতি আজ তাদের কেন এত অনীহা? সেই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেই ক্ষান্ত না হয়ে কেন তারা একের পর এক গণহত্যা চালাচ্ছে; বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের গুম করছে; অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন-গ্রেফতার চালাচ্ছে? পুরো দেশ যেন আজ একটি কারাগার, যেখানে জান-মালের নিরাপত্তা নেই; আছে কেবল ভীতি ও আতঙ্ক। নিরপেক্ষ নির্বাচনে অপমানজনক পরাজয় আর গণহত্যা-নৈরাজ্য-দুর্নীতি-অপশাসন সৃষ্টির দায়ে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর ভয় থেকেই কি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের এই অবস্থান? দেশবাসীর চাওয়া-পাওয়া, তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, এসবের কি কোনই মূল্য নেই? আওয়ামী লীগ কি আবারও চূড়ান্তভাবে সেই বাকশালে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে; যেখানে ভিন্ন মত, ভিন্ন আদর্শ আর সমালোচনাকে রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা হত্যা করা হত? বাকশালের পরিনতি সম্পর্কে আমরা সবাই জানি। তলাবিহীন ঝুড়িতে পরিনত হওয়া এ দেশের জন্য, এ দেশের মানুষের জন্য, এমনকি আওয়ামী লীগের জন্যও তা ভালো ফল বয়ে আনেনি। আমাদের সবার রাজনীতি যেহেতু দেশের কল্যাণার্থেই হওয়া উচিত, তাই মানুষকে সাথে নিয়ে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দিকে যাত্রা না করে কেন আমরা আবার সেই অরাজক অতীতে ফিরে যাব?
প্রিয় দেশবাসী
২০০৬ সালে সংবিধান অনুযায়ী বিচারপতি কে.এম. হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগ মেনে নেয়নি। অভিযোগ করা হয়েছিল যে বিচারপতি কে.এম. হাসান বিএনপিপন্থী। অথচ আজ যে শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হতে চাচ্ছেন, তিনি কেবল অনিরেপক্ষই নন, খোদ আওয়ামী লীগের প্রধান। কোন ভরসায়, কিসের ভিত্তিতে – বিএনপি বা অন্য যে কোনো দল শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে? সংবিধান তো ঐশী বাণী নয় যে এটিকে পরিবর্তন করা যাবে না। দেশের প্রত্যেকটি মানুষের মত আমিও প্রশ্ন করতে চাই: সংবিধানের জন্য জনগণ, নাকি জনগণের জন্য সংবিধান? জনগনের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটাতে এ পর্যন্ত ১৫ বার আমাদের সংবিধান সংশোধিত হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশের সংবিধানে যদি ৯৮ বার সংশোধন এসে থাকে, তাহলে জনগণের চাওয়া অনুযায়ী, দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে, আমরা কেন ষোড়শ সংশোধনী করতে পারব না? নির্দলীয় সরকারের দাবি অসাংবিধানিক বলে সরকার এটিকে প্রত্যাখ্যান করছে। এটিই যদি তাদের যুক্তি হয়, তবে আমাদের সংবিধানের একটি সংশোধনও করা সম্ভব হত না। আমরা পড়ে থাকতাম সেই ১৯৭২ এর গণআকাংখা বিরোধী সংবিধানে। আওয়ামী লীগ যা বলছে, তা কোনো যুক্তির কথা নয়; বরং সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ আসনের আশির্বাদ নিয়ে দেশকে অভিশাপের দিকে ঠেলে দেওয়ার অপপ্রয়াস।
প্রিয় দেশবাসী
সরকার ১৮ দলীয় জোটসহ সকল বিরোধী দলকে বাইরে রেখে একদলীয় প্রহসনের নির্বাচন করার ষড়যন্ত্র করছে। অথচ দেশে-বিদেশে নানা জরিপ, পর্যালোচনা ও গবেষণা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ। বিভিন্ন পর্যায়ের স্থানীয় সরকার নির্বাচন, নৈমত্তিক নাগরিক অনুষ্ঠান, সংবিধান বিশেষজ্ঞদের আলোচনা, আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমের প্রতিবেদন, বহির্বিশ্বের কূটনীতিকদের ভাষ্য – সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে সব দলের অংশগ্রহনের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচন এখন বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ এর উপরেই নির্ভর করছে আমাদের গণতন্ত্র চর্চার সর্ববৃহত অধিকারের তথা ভোট প্রদানের ভবিষ্যত।
অথচ এরই মাঝে সরকার পরিকল্পিত ভাবে একটি প্রহসনের নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে। যেখানে অর্ধেকের বেশি আসনে ইতিমধ্যে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায়, কোনো প্রকার ভোট ছাড়াই, নির্বাচিত হয়ে গিয়েছেন ১৫০ জনেরও অধিক সরকার সমর্থিত প্রার্থী। বাকি যেসব আসন রয়েছে, সেখানেও নাম সর্বস্ব কিছু প্রার্থীতার কারণে জনগণ ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন বলে গনমাধ্যমসমূহে প্রকাশ পেয়েছে। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস, আমাদের সংবিধানের মূল ভিত্তি। আর সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে আওয়ামী লীগ আজ এমন একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যে নির্বাচনে একে তো কোন মানুষেরই ভোট দেওয়ার আগ্রহ নেই, উপরন্তু প্রার্থীহীনতার ফলে দেশের অর্ধেকেরও বেশি ভোটার চাইলেও ভোটাধিকার প্রয়োগ পারবেন না। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে আওয়ামী লীগকে মুক্তিকামী জনতা এমনভাবেই প্রত্যাখ্যান ও ধিক্কার জানালেন যে তারা শত চেষ্টা করেও একতরফা নির্বাচনে ৩০০টির এমনকি অর্ধেক আসনেও কোন প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড় করাতে পারল না। এ দেশের হতভাগ্য জনসাধারণকে ৫ বছর অন্তর ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতন্ত্র অনুশীলনের একমাত্র সুযোগ থেকেও তারা বঞ্চিত করতে চাইছে। গণতন্ত্রের সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে, শতাধিক দেশের রাজনৈতিক পটভূমি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্ব ইতিহাসে এমন প্রতারণামূলক নির্বাচন এর আগে কখনো ঘটেনি।
বাংলাদেশে আমরা যারা গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাস করি, আজ সময় এসেছে আমাদের সবার এক হয়ে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিরোধ, প্রতিহত ও বর্জন করার। ব্যক্তি স্বার্থে নয়, দলীয় স্বার্থে নয়; এটি করতে হবে দেশের স্বার্থে, দেশের ভবিষ্যতের স্বার্থে, দেশের অস্তিত্বের স্বার্থে। শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীত্ব নয়, শান্তি চান। আর সেই শান্তির পূর্বশর্ত দেশের মানুষের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে পাতানো নির্বাচনের খেলা বন্ধ করা। আমি আহবান জানাবো, আসুন, আমরা সূচনা করি আগামীর নতুন বাংলাদেশের। স্বভাবতই, বিশ্বের একটি উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে সম্ভাবনাময় ও সমৃদ্ধ আগামীতে পৌছানোর পূর্বশর্ত একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক ব্যবস্থা। যেখানে মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে, গণতন্ত্রের সুষ্ঠু চর্চা থাকবে। বাংলাদেশের গত ৪২ বছরের ইতিহাসে প্রমাণ রয়েছে যে এ ভূখন্ডের মানুষ প্রকৃতপে শান্তিপ্রিয় এবং গণতন্ত্রমনা।
প্রিয় দেশবাসী, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান তা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর গণতন্ত্র, উন্নয়ন, বহু মত ও পথের পরিবর্তে যখন একদলীয় বাকশাল কায়েম করা হয়েছিল, তখন তিনি দেশে বহুদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে আবারও স্বৈরাচার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠলে বর্তমানে কার্যত গৃহবন্দী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আমরা গণতন্ত্রকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছি। দেশের জনগণ সেই গণতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়েছে এবং দশকের পর দশক ধরে তা লালিত হচ্ছে প্রবল আবেগ ও অনুভুতির সংমিশ্রণে। তারই ধারাবাহিকতায় আজ বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় ঐক্যজোট দেশব্যাপী আন্দোলন করছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের। দেশবাসীকে সাথে নিয়ে গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখতে আমাদের যে আন্দোলন, তাতে অনেক নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। তাদের উৎসর্গের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য হলেও আমাদেরকে ঘরে-ঘরে, গ্রামে-গ্রামে, শহরে-শহরে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আন্দোলনে শহীদ সকল ব্যক্তির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাদের পরিবার সমূহের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। কথা দিচ্ছি, তাদের আতœত্যাগকে আমরা বৃথা যেতে দেব না। ইনশাআল্লাহ, এ দেশে আবারো আমরা গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনব; নিশ্চিত করব উন্নয়ন ও উৎপাদনের রাজনীতি; বয়ে আনব আর্থিক ও সামাজিক অগ্রগতি।
আমি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, আপনারা আমাদেরই মত দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করছেন। দেশের মানুষের মতামত ও তাদের বক্তব্য উপলব্ধি করা আপনাদের রাজনৈতিক স্বার্থেই একটি অবশ্যকরণীয়। ভেবে দেখুন, দেশের সার্বভৌমত্বকে বিসর্জন দিয়ে, পদে-পদে আমাদের প্রাণপ্রিয় ইসলাম ও ধর্মীয় সম্প্রীতিকে রক্তাক্ত করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মত গণদাবীকে ধূলিস্যাৎ করে, এমন লজ্জাজনক নির্বাচন কি একটি তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলকে মানায়? এই নির্বাচন দিয়ে মানুষের ঘৃণা-অভিশাপ ছাড়া আপনাদের আর কী অর্জন হবে? স্বাধীনতার স্বপক্ষের দাবীদার হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতি -যেখানে আপনাদের সরকারের স্থায়ীত্ম নির্ভর করে অন্য এক রাষ্ট্রের নীতির উপর, যেখানে সরকার দেশবাসীর উপর পরাধীনতার শৃংখল চাপিয়ে দেয় সেই রাজনীতি আপনারা কী করে মেনে নেন? এ কেমন রাজনৈতিক সমর্থন যা দেশের গভীর সংকটেও দলীয় আনুগত্যকে জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে দেশের মানুষের উপর নৃশংসতা চালায়? ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এর পরিণাম শুভ হয় না।
পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও প্রশাসন সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিদের মনে রাখতে হবে যে আপনারা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মী। দেশের পরিস্থিতি, বা সরকারে থাকা দলের উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনা যাই হোক, আপনারা দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। আপনাদের চালক আপনাদের বিবেক, আর আপনাদের চাকুরিদাতা এই দেশের খেটে খাওয়া মানুষ – যাদের কষ্টার্জিত অর্থে আপনাদের সংস্থান হয়। এই মানুষদের উপর জুলুম-নির্যাতনে আপনাদের অনেকেরই অংশগ্রহণ রয়েছে। আপনাদের পরিবার-পরিজনরাই তা মেনে নিতে পারছেন না, আমি নিশ্চিত । রাজনৈতিক অচলাবস্থার শীঘ্রই নিরসন হবে। আজ যারা গণবিরোধী কাজ করতে আপনাদের প্রণোদনা দিচ্ছে, গণমানুষের চাপে যখন তাদের অবশ্যম্ভাবী পতন ঘটবে, তখন জনতার কাঠগড়ায় সেই সব অপরাধীদের পাশাপাশি যদি আপনাদেরও দাঁড়াতে হয়, তবে তা হবে অত্যন্ত লজ্জার ও কলংকের।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে পরিমাণ সেনা কর্মকর্তা আমরা হারাইনি, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক সেনা কর্মকর্তাকে তাদের পরিবার পরিজনসহ হত্যা, নির্যাতন ও লাঞ্ছিত করা হল আমাদের রাজধানীরই বুকে। জাতিসংঘের শাস্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ অবদান রাখা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের ভেতরে যেভাবে আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য প্রণোদিত অশান্তি ও রক্তপাতের শিকার হয়েছে, তা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ। এত প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিডিআর আর সেনা বাহিনীকেই কেন আওয়ামী লীগের প্রথম ও প্রচন্ড ষড়যন্ত্রের শিকার হতে হল, স্বাধীনতাকামী-সার্বভৌমত্বকামী বাংলাদেশিদের কাছে তা সহজে বোধগম্য।
কৃষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পেশাজীবি, শিক্ষার্থী, শ্রমিক, গৃহিণী তথা সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের প্রতি আহবান জানিয়ে বলছি, দেশের রাজনীতিতে আজকের দু’টি পক্ষ বিএনপি বনাম আওয়ামী লীগ নয়, ১৮ দল বনাম মহাজোট নয়। দু’টি পক্ষ আজ গণতন্ত্র বনাম স্বৈরতন্ত্র, বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি বনাম অন্য দেশের পক্ষের শক্তি, গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্খা বনাম ব্যাক্তি বিশেষের ক্ষমতার অভিলাষ। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা প্রত্যেকে একেকজন রাজনীতি সচেতন নাগরিক। দেশকে নিয়ে আপনাদের চিন্তা-চেতনা আমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। পরিস্থিতির বিচারে আজ কোন পক্ষটি আপনাদের অবলম্বন করা উচিত, তা আপনাদেরই সিদ্ধান্ত। যে নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না বলে আপনারা সবাই বিশ্বাস করেন, সেই ব্যবস্থার পক্ষেই আমাদের এত সংগ্রাম। তাই এই সংগ্রাম আমাদের একার নয়, এটি আপনাদেরও সংগ্রাম। আমরা সবাই মিলে এই প্রহসনের নির্বাচন আর এই স্বৈরাচারী সরকারকে বয়কট ও প্রতিরোধ করব কিনা, তার উপর নির্ভর করছে স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব।
বিএনপি ও ১৮ দলের সর্বস্তরের নেতা, কর্মী ও সমর্থকের উদ্দেশ্যে বলছি – ইতিহাস ও রাজনীতির পালাবদল আমাদেরকে আজ এক অন্যরকম অবস্থানে নিয়ে এসেছে। সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী থেকে আজ আমরা পরিণত হয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সেনানীতে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার “দেশ বাঁচাও, মানুষ বাঁচাও” শ্লোগানের মর্মার্থ আজ দেশবাসী পদে-পদে অনুভব করছে। উজ্জ্বল প্রভাতের পূর্বে রাত যেমন গভীর ও অন্ধকার হয়, তেমনি আমাদের উপর নেমে এসেছে অন্য দেশের তাবেদারীতে নিমজ্জিত জনবিচ্ছিন্ন আওয়ামী লীগের গুম, খুন, হামলা, মামলা ও নির্যাতনের স্টীমরোলার। আজ আমাদের লড়াই কোন সাধারণ রাজনৈতিক কর্মকান্ড নয়। আজ আমাদের লড়াই একটি বন্দী জাতির মুক্তির জন্য এক অশুভ আশীর্বাদপুষ্ট স্বৈরাচারীর বিরুদ্ধে। সেই অশুভ তৎপরতাই একদিন আমাকে আপনাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে অনেক দূরে নিয়ে গিয়েছিল। আজও শারীরিক অসুস্থতার জন্য আমি সশরীরে আপনাদের মাঝে উপস্থিত নেই। তবে আমি প্রতিটি মুহুর্তে নিজেকে আপনাদের মাঝেই অনুভব করি। আপনাদের উপর আসা আঘাত, আপনাদের ত্যাগ, আপনাদের সংগ্রাম আমাকে সর্বদা আচ্ছন্ন করে রাখে। আপনাদের প্রতি আমি আহবান জানাই, এখন সর্বশক্তি দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময়। আর নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা নয়। এখন থেকে লক্ষ্য একটাই – সকল ুদ্র বিভাজন ভুলে স্বৈরাচারী সরকার আর তার প্রহসনের নির্বাচনকে যেকোন মূল্যে প্রতিহত করতে হবে। আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী আর অন্ধ সমর্থক ছাড়া প্রতিটি বাংলাদেশি নারী ও পুরুষ আমাদের সাথে রয়েছেন। কেউ সশরীরে আছেন; আর বাকিদের সমর্থন, প্রেরণা ও দোয়া আমাদের সাথে আছে। দেশের মানুষ রাজনৈতিক সংকট থেকে মুক্তির কামনায় চেয়ে আছেন বিএনপির দিকে, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের দিকে। এত জনসমর্থিত একটি আন্দোলনের সাফল্য ইনশাল্লাহ অনিবার্য। প্রয়োজন শুধু এই সংগ্রামকে – যা চলে আসছে আমাদের বিপুল ত্যাগ-তীতিক্ষ, বহু সহযোদ্ধা ও নিরপরাধ সাধারণ মানুষের প্রাণের মূল্যে সেই সংগ্রামকে, এই দেশ ও জাতির স্বার্থে যেকোন মূল্যে অব্যাহত রাখা।
প্রিয় দেশবাসী
বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আজ সময়ের অন্যতম দাবী। সেই পরিবর্তনের মূল ভিত্তি হবে রাজনীতিতে জাতীয় ঐক্য ও আপনাদের নতুনধারার অংশগ্রহণ। আসুন, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আজকের আন্দোলনকে সফল করে আমরা পরিবর্তনের সেই রাজনীতির পথকে প্রশস্ত করি।