সাধারণ ভোটার লাগবে না। কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকবে দলীয় কর্মীদের সারি। দিনভর তারাই ভোট দেবেন পর্যায়ক্রমে। অন্তত ১০০ জন কর্মীর সারি রাখতে হবে সার্বক্ষণিক। আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দলীয় সমাবেশে প্রকাশ্যে এমন নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শেখ আফিল উদ্দিন। তিনি তার আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী আসনে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী সভায় অংশ নিয়ে প্রকাশ্যে এমন পরিকল্পনার কথা জানান। তার বক্তব্য প্রচারের পর যশোরজুড়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। তার এ বক্তব্যের অডিও রেকর্ড করে বিক্রি করা হচ্ছে দোকানে দোকানে। বিষয়টি নজরে দেয়া হয়েছে নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের।
ওই নির্বাচনী সভায় যশোর-১ আসনের এমপি শেখ আফিল কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ভোটকেন্দ্রে ভোটারের দরকার নেই। ভোটাররা ভোট দেখতে আসবেন। কোন সমস্যা নেই। আর আপনারা যারা আমার নৌকা মার্কার এজেন্ট বা কর্মী তারা সকাল থেকে ভোটকেন্দ্রে লাইন দিয়ে পর্যায়ক্রমে ভোট দেবেন। প্রতিটি কেন্দ্রে ১শ’ জন করে কর্মী সার্বক্ষণিক উপস্থিত থাকবেন। একজন ভোটকেন্দ্রে যাবেন। পেছনে ৯৯ জন অপেক্ষা করবেন। এভাবে সারা দিনই ওই ১০০ জন কর্মীই ভোট শেষ করবেন। সাধারণ ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সাংবাদিকরা এসে ছবি তুলে নিয়ে যাবেন। সবাই দেখবেন কেন্দ্রে পর্যাপ্ত ভোটার আছে। গত পরশু সন্ধ্যায় যশোর-২ চৌগাছা ঝিকরগাছা সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এডভোকেট মনিরুল ইসলামের এক নির্বাচনী কর্মিসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন আফিল উদ্দিন। এ আসনে মনিরুলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ রফিকুল ইসলাম।
গত ৩০শে ডিসেম্বর ঝিকরগাছা উপজেলার পারবাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এডভোকেট মনিরুল ইসলামের পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। এ সভায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এডভোকেট মনিরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় আফিল উদ্দিন বলেন, প্রতিটি কেন্দ্রে তার উপজেলা থেকে ১শ’ নির্ভীক কর্মী উপস্থিত থাকবে। তারা ভোট দিয়ে আবার লাইনে এসে দাঁড়াবে এবং ফের ভোট দেবে। এভাবে সারা দিন তারা ভোট দিয়ে যাবে। প্রশাসনিক কোন ভয় নেই; সেটা আমি দেখবে। নির্বাচনী এজেন্টদের উদ্দেশে দেয়া এ বক্তব্য রেকর্ড করেছেন যশোর-২ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের লোকজন। অধ্যাপক রফিকুলের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট শাহীন-উল-কবীর ওই রেকর্ডকৃত বক্তব্যের সিডিসহ গতকাল জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে অভিযোগ হিসেবে জমা দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে স্থানীয় সাংবাদিকদের ও যশোরের রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক মোস্তাফিজুর রহমানকে জানান, তিনি অভিযোগটি গ্রহণ করেছেন। একই সঙ্গে অভিযোগটি তিনি নির্বাচন সংক্রান্ত ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির কাছে পাঠিয়েছেন। কমিটি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
এ ব্যাপারে বক্তব্য নেয়ার জন্য এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আফিল গ্রুপের পরিচালক ও এমপি আফিলের ঘনিষ্ঠ সহচর মাহাবুবুল আলম লাভলুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সংসদ সদস্য ব্যস্ত। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না।
শেখ আফিল উদ্দিন যা বলেছেন
মতবিনিময় সভায় আফিল উদ্দিন বলেছেন, পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে যেন ফিরে না আসতে হয়। সাহস সঞ্চারের জন্য আমি আপনাদের বলে যাচ্ছি, আমার শার্শা উপজেলায় আপনাদের ৬টি ইউনিয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আমি আমার শার্শা উপজেলার আওয়ামী লীগের সব নেতাকে ডেকেছিলাম গত পরশু। তাকে আমরা বলেছি ঝিকরগাছার নির্বাচনে আগামী ৫ তারিখ আমাদের কি করতে হবে। ইনশাআল্লাহ আমি আমার নেতাদের নির্দেশ দিয়েছি। আপনাদের ভোটার লিস্ট নিয়ে নিয়েছি। আমার নেতারা আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে, কোন ভুল হবে না। শঙ্করপুর থেকে শুরু করে নাভারন হাজিরবাগ দিয়ে চলে যাবে শিমুলিয়া দিয়ে গঙ্গানন্দপুর। অন্তত ৬টি ইউনিয়নের সঙ্গে আমার ইউনিয়ন কানেকটেড। সুতরাং আমি বিশ্বাস করি সেদিন আমার সব লোক আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। সবাইকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আমি আপনাদের সাহস দিলাম। বিনয়ের সঙ্গে বলছি, মনিরুলকে পছন্দ করি না, করি ভিন্ন ইস্যু। কিন্তু আমরা পরাজিত হয়ে ফিরতে চাই না। আমাদের নৌকাকে ভোট দিতে হবে।’ তিনি শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের প্রশংসা করে বলেন, ‘সেখানে আমার কিছু করতে হয় না। নেতাকর্মীরাই সব কিছু করে আমাকে জানান। তারাই আমাকে বলেছেন, ঝিকরগাছার নির্বাচনে কি করতে হবে বলেন? আমি তাদের নির্দেশ দিয়েছি আমার নির্বাচনী এলাকা সংলগ্ন ঝিকরগাছার ৬টি ইউনিয়নের ভোট কাস্টিংয়ের দায়িত্ব তাদের নিতে হবে। তারা প্রস্তুত। এসব ইউনিয়নের ভোটকেন্দ্র নিয়ে ঝিকরগাছার মানুষকে ভাবতে হবে না। এসব ইউনিয়নে ভোট করবে শার্শার কর্মীরা। প্রতিটি কেন্দ্রে আমার নির্বাচনী এলাকার ১০০ জন করে কর্মী থাকবে। তারা পর্যায়ক্রমে ভোট দেবে। কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারদের ভোট দিতে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রের বাইরে ঘুরবে, ফিরবে আর সময় হলে বাড়ি চলে যাবে।’ তবে ভোটকেন্দ্রের বাইরে লোক সমাগম রাখার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়ে শেখ আফিল আরও বলেন, ‘আপনারা যদি কোন প্রশাসনিক সমস্যায় পড়েন আমাকে বলবেন; আমি জবাব দেবো। তার জন্য যা যা করণীয় ভোট মাঠে তা কিন্তু করা লাগবে, আমি তো মাইকে বলতে পারবো না কি করা লাগবে। একা একা জিজ্ঞেস করলে বলে দিব। সুন্দর করে ভোট করবেন। ভোট যেন নৌকা পায় সেভাবে সুন্দর করে ভোট করবেন। মাঠ যেন ফাঁকা না হয়ে যায়। ১০০ ছেলে ভোটের মাঠে লাইন থাকবে। বুথে যাবে, আবারও ওরা এসে পেছনে দাঁড়াবে। ওরা বাড়ি যাবে না। ১০০ ছেলে সব সময় লাইনে থাকবে, বুথের ভেতরে ১ জন ঢুকবে, আবার পেছনে আসবে, তার সামনে ৯৯ জন থাকবে। এভাবে যাবে, আবার আসবে। লোক ও সাংবাদিকরা আসবে দেখবেন যে মাঠ ভরা।’ ‘হাজার হাজার লোক আসবে, নো প্রবলেম। আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে ভোট দেবেন। শুধু ভোটকেন্দ্রে যাবেন আর আসবেন। এতে ঝামেলার কিছু নেই।’
শেখ আফিলের এ ঘোষণার পর ঝিকরগাছার নির্বাচনী পরিবেশ পাল্টে যেতে শুরু করেছে। ভোটারদের মধ্যে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রফিকুল ইসলাম ও তার নির্বাচনী কর্মীরাও এ ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। ইতিমধ্যে তারা বিষয়টি লিখিত আকারে জেলা রিটার্নিং অফিসারকে জানিয়ে বিচার প্রার্থনা করেছেন। অন্যদিকে গত ২৯শে ডিসেম্বর রফিকুল ইসলাম যশোরে প্রেস কনফারেন্স করে জানিয়েছিলেন তার নির্বাচনী এলাকায় ভোট ডাকাতির পরিকল্পনা হচ্ছে। প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও তার কর্মী-সমর্থকরা ভোট ডাকাতি করে তার বিজয় ছিনিয়ে নিতে পারে। ইতিমধ্যে তার এক কর্মীকে হত্যা করেছে এ চক্র। তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত খুনিদের আটকের দাবিতে আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছিলেন।