বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও আর্থ্রাইটিস রোগে ভুগছেন। এর মধ্যে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় চিন্তিত দলের নেতাকর্মীরা। শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের ইতিবাচক কথাবার্তায়ও দলটির নেতাকর্মীরা চিন্তামুক্ত থাকতে পারছেন না।
কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার রোগমুক্তি কামনা করে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। ঢাকায় থাকা সিনিয়র নেতাদের কাছে ফোন করেও দলীয় চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থা জানতে চাইছেন তারা। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। কোনো উপসর্গও নেই বলে জানিয়েছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা।
সোমবার বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে বাসভবন ‘ফিরোজায়’ যান তার ব্যক্তিগত মেডিকেল বোর্ডে থাকা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। সেখানে শারীরিক অবস্থা পর্যালোচনা করতে বৈঠকও করেন তারা। বিএনপি চেয়ারপারসনকে দেখে আসার পর তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের প্রধান মেডিসিন ও বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানান, আমরা এখন পর্যন্ত বলব, তার (খালেদা জিয়া) অবস্থা স্থিতিশীল। সোমবার পর্যন্ত যথেষ্ট ভালো আছেন। আমরা আশা করছি, এভাবে আরেক সপ্তাহ পার হলে তিনি বিপদ থেকে মুক্ত হবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, মেডিকেল বোর্ডে আমাদের অনেক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা রয়েছেন। সবচেয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাজ্যে থাকা তার ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান সব সময় মোটিভেট করছেন। আমরা একটা টিমওয়ার্ক হিসাবে আলোচনা করে তার চিকিৎসা করছি। কোথাও কোনো গ্যাপ বা কোনো রকমের সন্দেহের কিছু অবকাশ নেই। এখন পর্যন্ত তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো আছে বলে মনে হচ্ছে।
খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে চিকিৎসক টিমের প্রধান বলেন, বিন্দুমাত্র আমাদের যদি মনে হয় যে, তাকে হাসপাতালে নেওয়া দরকার, আমরা সেই মুহূর্তে তাৎক্ষণিক হাসপাতালে নিয়ে যাব-সেই ধরনের প্রস্তুতি আমরা রেখেছি।
এদিকে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় সারা দেশে সব পর্যায়ের নেতাকর্মী ও শুভানুধ্যায়ীদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে দোয়া কর্মসূচি পালনের অনুরোধ করেছে বিএনপি। মসজিদ ও অন্যান্য উপাসনালয়ে এবং যার যার অবস্থান থেকে দোয়া মাহফিল, কুরআন খতম ও অন্যান্য ধর্মমতে প্রার্থনা অনুষ্ঠান করার জন্য দলটির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে। দলের একাধিক নেতা বলেন, চিন্তামুক্ত থাকতে পারছি না। কারণ, ৭৫ বছর বয়সি চেয়ারপারসনের ডায়াবেটিস ও অ্যাজমা রোগ রয়েছে-যা করোনা বিপদে ফেলে দিতে পারে। এ অবস্থায় চিকিৎসার পাশাপাশি নেতাকর্মীরা নিজ নিজ ধর্মের রীতিনীতি মেনে তার আরোগ্য কামনায় দোয়া প্রার্থনা করছেন।
জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের ভালোবাসা ও আস্থার ভরসাস্থল দেশনেত্রী খালেদা জিয়া। আগে থেকেই তিনি কয়েকটি রোগে ভুগছেন। এখন আবার করোনা পজিটিভ এসেছে। আমরা এ নিয়ে কিছুটা চিন্তায় আছি। তবে এখন পর্যন্ত তিনি ভালো আছেন। তার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চাই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, আমরা চেয়ারপারসনকে যেভাবে দেখেছি তাতে করে কঠিন বিপদেও তিনি মনোবল শক্ত রাখতে পারেন। আমি যতটুকু খোঁজ নিয়েছি এখনো তার মনোবল বেশ শক্ত। আশা করি, এই অবস্থায় সৃষ্টিরকর্তার কৃপায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। তার অসুস্থতার খবরে নেতাকর্মীসহ দেশের সাধারণ মানুষও তার জন্য প্রার্থনা করছেন। আমি শুনেছি মুসলমান ভাই বোনেরা নফল রোজা রেখেছেন, নামাজও আদায় করছেন। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রার্থনা ফেলে দিতে পারবেন না বলে আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবর শুনেই বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক নেতাকর্মী ঢাকায় চলে এসেছেন। দূরপাল্লার পরিবহণ বন্ধ থাকার পরও কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে, আবার কেউ গাড়ি ভাড়া করে এসেছেন। ঢাকায় অবস্থান করা নেতাদের বাসায় গিয়ে দলীয় চেয়ারপারসনের খবর নিচ্ছেন। ফোন করেও তাদের উদ্বেগের কথা জানাচ্ছেন।
আসলে দলীয় নেতাকর্মী ও দেশবাসীর আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসার জায়গায় খালেদা জিয়া। বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সহসম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল যুগান্তরকে বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবরে সারা দেশে দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী-সমর্থকসহ দেশবাসী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
দীর্ঘ কারাবাসে তিনি প্রয়োজনীয় উন্নত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। আমাদের দাবিকে উপেক্ষা করে সরকার তাকে বিদেশে গিয়ে উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ না দিয়ে এখনো চরম অমানবিকতার পরিচয় দিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে তার বয়স এবং শারীরিক নানা জটিল অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে আমরা কেবল গভীরভাবে উদ্বিগ্নই নই, দিশেহারা হয়ে পড়েছি।
আমরা কেবলই মহান আল্লাহর কাছে তার রোগমুক্তি ও সুস্থতা কামনা করছি এবং এই কঠিন সময়ে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে তাকে পরিপূর্ণভাবে মুক্তি দেওয়ার জন্য দাবি জানাচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাহমুদুর রহমান সুমন বলেন, খালেদা জিয়া জাতীয়তাবাদের শক্তি ও গণতন্ত্রের প্রতীক। তিনি বাংলাদেশের গণমানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার আশার আলো।
দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন খালেদা জিয়া : খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দলের প্রধান অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানান, খালেদা জিয়া সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবাই যেন তার জন্য দোয়া করেন। সবাই যেন সাবধানে থাকেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।
ফিরোজা ভবনের অন্যরা কেমন আছেন জানতে চাইলে অধ্যাপক সিদ্দিকী বলেন, সবাই কোভিড পজিটিভ। প্রত্যেককে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রথম দিকে ১-২ জনের জ্বর ছিল। ওদের এখন জ্বর নেই, সবাইকে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। সবাইকে চিকিৎসা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী আরও বলেন, ম্যাডাম শুধু নিজেরই না, অন্যরা ওষুধ খাচ্ছে কি না সেটাও তদারকি করছেন।
তিনি জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসক টিমের বৈঠকে অনলাইনে আরও কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অংশ নেন। এছাড়া লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানও ইন্টারনেটে যুক্ত থেকে বৈঠকে অংশ নেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিকিৎসক টিমের সদস্য বক্ষব্যাধি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আব্দুস শাকুর খান, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন, ডা. মো. আল মামুন ও চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইংয়ের সদস্য শায়রুল কবির খান।
রোগমুক্তি কামনায় দোয়া ও প্রার্থনা :
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসাবে খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় সোমবার বাদ জোহর রাজধানীর নয়াপল্টন জামে মসজিদে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান ও সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় সবাইকে দোয়া করার আহ্বান জানান।
মিলাদ ও দোয়া পরিচালনা করেন নয়াপল্টন জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আমিনুল ইসলাম। এতে অংশ নেন বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা ডা. রফিকুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ, এমএ মালেক, অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ, শহীদুল ইসলাম বাবুল, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তাইফুল ইসলাম টিপু, মনির হোসেন, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, আমিরুজ্জামান খান শিমুল, হায়দার আলী খান লেলিন, ওমর ফারুক শাফিন প্রমুখ।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের উদ্যোগে বিকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হয়। করোনা পরিস্থিতিতে সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রার্থনা অনুষ্ঠানে ছিলেন-গৌতম চক্রবর্তী, সুকৃতি মণ্ডল, অমলেন্দু দাস, রমেশ দত্ত, তরুণ দে, মিল্টন বৈদ্য, জয়দেব জয়, সুবীর বদ্ধন, সন্জয় গুপ্ত, মিন্টু বসু প্রমুখ।
এছাড়া জাতীয়তাবাদী শিক্ষক, চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারীর উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বাদ জোহর কুরআন খতম ও দোয়ার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেন ডা. আব্দুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ডা. গোলাম মুইনুদ্দিন, ডা. নজরুল ইসলাম, ডা. সাইফুল ইসলাম সেলিম, ডা. ছফিউল্লাহ, ডা. নওরোজ প্রমুখ।