আর মিছিল করবি? মিছিলের মজা দেখাচ্ছি, এখন কই যাবি, ধরা তো পড়ছিস- বলে আট থেকে দশ পাষ ইট ও লাঠি দিয়ে অনবরত আঘাত করতে থাকে। ইট দিয়ে হাতের উপর ও লাঠি দিয়ে পিঠে ও শরীরের অন্যান্য অংশে অনবরত আঘাত করতে থাকে। তাদের লাঠির আঘাতের ফলে পায়ের পাতা ফেঁটে রক্ত ঝরছিল। অসহায় আমি আর না মারার জন্য দুর্বৃত্তদের অনুরোধ করি। কিন্তু রক্ষা পাইনি। অবশেষে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপরও তারা কতক্ষণ আমাকে নির্যাতন করেছিল তা জানি না। পরে জানতে পারি সাংবাদিক এবং আদালতের কর্মচারীরা আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। এভাবেই কথাগুলো জানালেন গত রোববার হামলার শিকার সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রেহানা পারভীন।
তিনি বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের এ নির্মম নির্যাতন আমাকে ’৭১ পরবর্তী বাকশালী বর্বরতার কথা মনে করিয়ে দেয়। যেখানে আদালতের একজন নারী আইনজীবীকে নির্মম নির্যাতনে তারা পিছপা হয়না। তাদের হাত একটুও কাঁপেনি সেখানে সাধারণ নারীরা তাদের হাতে কেমন নির্যাতনের শিকার হয়, তা ভাবতেও শরীরে কাঁপুনি উঠে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত দুই দিন যাবত হাসপাতাল ও বাসায় বিছানায় শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন এই আইনজীবী। পায়ে ছটি সেলাই, দুই হাত নড়াচড়া করতে পারেন না। কাপড়ের নীচে সারা শরীরে ইটের ও লাঠির আঘাতের কালো ছোপ ছোপ দাগ। অন্যের সাহায্য নিয়ে চলাফেরার চেষ্টা করছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের অন্যতম সদস্য রেহানা পারভীন।
বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ইনকিলাবকে তার উপর নির্যাতনের নির্মম কাহিনী বর্ণনা করতে করতে অঝোরে কাঁদতে থাকেন। তিনি জানান, ঐদিন সকাল থেকেই আইনজীবীরা মিলে মিছিল করছিলাম। গেটে সবাই অবস্থানকালে হঠাৎ ঝাঁকে ঝাঁকে দলবেঁধে বহিরাগতরা প্রবেশ করলে অন্যদের সাথে আমিও দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু প্রধান বিচারপতির কক্ষের সামনে যেতে না যেতেই পেছন থেকে পিঠে লাঠি দিয়ে আঘাত করে এক দুর্বৃত্ত। গতি কমে যায় দৌড়ের। এসময় পায়ে আঘাত করলে এরপর আর এগিয়ে যেতে পারিনি। পরে ৮ থেকে ১০ পাষ- আমার উপর বিভিন্নভাবে আক্রমণ করে। বাঁচার জন্য তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করলেও তারা আমাকে মাটিতে ফেলে পেটাতে থাকে। শরীরের স্পর্শকাতর অংগে তারা লাঠি দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এ সময় তারা নারকীয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। আমি বলি আপনারা তো আইনজীবী নন, আমি একজন মহিলা আইনজীবী। আপনারা এ কি করছেন। এরপর অজ্ঞান হয়ে আমি মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে যাই। এরপর কে বা কারা আমাকে উদ্ধার করে সঠিকভাবে বলতে পারব না। পরে শুনছি সাংবাদিকরা ও আদালতের কর্মচারীরা তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে কর্মচারীদের একটি কক্ষের বিছানায় কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখেন। কর্মচারীরা কাপড় দিয়ে আমার শরীরের বিভিন্ন ক্ষত স্থান থেকে বের হওয়া রক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টা করেন। রক্ত পড়া বন্ধ না হলে পিছনের গেট (সড়ক ভবন) বর্তমান কোর্টের প্রশাসনিক ভবনের পাশ দিয়ে তারা আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। সেখানে পায়ে ৬টি সেলাই দিয়ে রক্ত বন্ধ করতে সক্ষম হন চিকিৎসকরা। সেখানেও আবার আমার উপর হামলা হতে পারে এই ভয়ে চিকিৎসা শেষে পরিবারের সদস্যরা আমাকে বাসায় নিয়ে আসেন। পরে গতকাল ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে পায়ে, কোমড়ে ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি এক্সরে ও অন্যান্য পরীক্ষার পর বাসায় বিছানায় শুয়ে আছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য রেহানা পারভীন।
তিনি আরো জানান, এখানেও আমার ভয় হয় কখন না তারা আবার বাসায় এসে আক্রমণ করে বসে। কারণ, আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের হাতে এ দেশের কারো জীবন এখন নিরাপদ নেই। চিকিৎসকরা বলেছেন, শরীরের পেছনের অংশ ও ডান হাতের উপরের অংশ ইটের আঘাতে থেতলে গেছে। আঘাতের পরিমাণ এখানে বেশী ছিল। এগুলো সেরে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে। রেহানা পারভীন প্রায় ৫ থেকে ৭ বছর যাবত সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী হিসাবে কাজ করে আসছেন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য এবং তারেক রহমান সমাজ কল্যাণ পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
প্রসঙ্গত, গত রোববার সুপ্রিম কোর্টে বিএনপি-জামায়াত সমর্থক আইনজীবীদের ওপর হামলা চালায় সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। এ সময় দুই নারী আইনজীবীকে তারা নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠে। তাদের মধ্যে রেহানা পারভীনের উপর পাষ-দের নির্যাতনের ছবিটি গত সোমবার গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে বিশ্বখ্যাত মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস।
উৎসঃ inqilab