তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ
‘যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন।’ কবির এমন চরণটি এবার প্রতিফলিত হচ্ছে হাওরের দরিদ্র মানুষদের জন্য। সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, দিরাই-শাল্লা, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, তাহিরপুর হাওর এলাকার নিচু জমি ও নদী থেকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার উপযোগী হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে একধরনের কয়লাসদৃশ কালোমাটি।
হাওর এলাকার গ্রামে-গ্রামে পরিবেশবান্ধব এই কালোমাটি প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে রানাবান্নার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
আর এতে করে বনজসম্পদ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এই কালোমাটি। বিল, ধানী জমি, কিছুটা খনন করে ও নদীতে পানির নিচে এই মাটি পাওয়া যাচ্ছে। এই কালোমাটি দিয়ে তৈরি জ্বালানি ব্যবহার করে দরিদ্র ও শ্রমজীবী নারী-পুরুষ বাড়তি আয়সহ পরিবারের জ্বালানি আয় সাশ্রয় করছেন। জেলার জামালগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী তাহিরপুর, দিরাই, ধরমপাশা, দিরাই-শাল্লা ও দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার অনেক পরিবারের লোকজন বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এই মাটি ব্যবহার করে আসছেন। প্রতি বছর শুকনো মওসুমে ফেব্রুয়ারির শেষের দিক থেকে মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাত না হলে হাওর এলাকায় বসবাসকারী লোকজন এই মাটি সংগ্রহ করে থাকেন। সুরমা, বৌলাই, রক্তি নদীসহ বেশ কয়েকটি নদীতে ও কাই হাওর, সাংহাই হাওর, সেফটি হাওর, ভরাম হাওর, নলুয়ার হাওর, পাকনা হাওর, হালির হাওর, ধারাম হাওর, ধানকুনিয়া হাওরসহ বেশ কয়েকটি নিচু এলাকার হাওরে এই কালোমাটি পাওয়া যাচ্ছে।
শুষ্ক নদী ও হাওরের তলদেশ সাত থেকে ১০ ফুট গভীরতায় এই কালোমাটি পাওয়া যায়। নদী বা হাওর থেকে এই মাটি সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে জ্বালানি তৈরি করা হয়। কালোমাটিকে জ্বালানি উপযোগী করতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লাগে। প্রক্রিয়াজাত প্রতি মণ মাটি দিয়ে একটি পরিবারের এক সপ্তাহ রান্নাবান্না করা যায়। আবার অনেকেই এই মাটি আহরণ করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে সারা বছর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য মওজুদ করছেন। কেউ বা বাজারজাত করে বাড়তি আয়ের মাধ্যমে পরিবারের খরচ মেটাচ্ছেন। এ জ্বালানি হাওরাঞ্চলে তৈরি করছে এক ধরনের লাকড়ি (জ্বালানি) বাজার। কালোমাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। আর এগুলো প্রক্রিয়াজাতকরণে কয়েক হাজার নারী-পুরুষ শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। কালোমাটি ব্যবহারের ফলে গাছপালা ও বনজসম্পদ উজাড় করা থেকে রক্ষা পাচ্ছে পরিবেশ।
জামালগঞ্জ উপজেলার পাকনা হাওরের বাসিন্দা নয়ন মিয়া জানান, প্রতি বছর আমাদের হাওরের নিচু জমিগুলো সাত-আট হাত মাটি খুঁড়ে কালোমাটি উত্তোলন করে অনেক পরিবারই সারা বছরের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন। বেগম বানু বলেন, আগে গাছের ডালপালা কেটে রান্নার কাজে ব্যবহার করতাম। এখন কালোমাটি পাওয়ায় গাছ কাটতে হয় না। মনু মিয়া বলেন, আমাদের এলাকায় নদী ও হাওরের নিচু জায়গায় কিছু মাটি খুঁড়লেই কালোমাটি পাওয়া যায়। এগুলো প্রক্রিয়াজাত করে রোদে শুকিয়ে প্রায় সারা বছরই জ্বালানি ব্যবহার হয়। আগুন হয় খুব ভালো, ধোঁয়া হয় না। রান্না করা তরিতরকারিতে কোনো গন্ধও হয় না। গজারিয়া গ্রামের আকলিমা আক্তার সখী জানান, কালোমাটি দিয়ে রান্না করার জন্য লোহার রড দিয়ে নেট জালের মতো একটি বিশেষ ধরনের চুলা তৈরি করতে হয়। রান্না শেষে ছাইগুলো নেটের নিচে পড়ে থাকে এতে ঝামেলা পোহাতে হয় না। কালোমাটি পাওয়ায় বনায়নগুলো সঠিকমতো বাড়ছে।
এই মাটি পরিবেশের উপর বিরোপ প্রভাব সৃষ্টি করবে না। সরকারিভাবে সার্ভের মাধ্যমে এর প্রয়োজনীয়তা নিরূপণ করে এই কোলোমাটিকে একটি সাশ্রয়ী জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে এমনই অভিমত ব্যক্ত করেছেন এলাকার লোকজন।