ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :: সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইতিহাসের বর্বরোচিত গণধর্ষণ নিয়ে চতুর্দিকে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এমন নির্মম পৈশাচিক ঘটনার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক, যৌক্তিক ও সঙ্গত। তবে এই বর্বরোচিত ঘটনার বিচার ও শাস্তির ব্যাপারে সোসাল মিডিয়ায় অতি আবেগ পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু আইন-আদালত ও ন্যায় বিচার আবেগ দিয়ে চলে না। বাঁধভাঙ্গা অতি আবেগ থেকেই কিন্তু আইন হাতে তুলে নেয়া ও সমাজে ন্যায় বিচারহীনতার সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। আসুন সর্বাবস্থায় আমরা আইনের পক্ষে থাকি, থাকি ন্যায় বিচারের পক্ষে।
জাতিগতভাবে আমরা প্রচন্ড আবেগপ্রবণ। ঘটনার মূলে আমরা যাই না, ঘটনার গভীরে গিয়ে এই ঘটনাগুলোর মূল কারন তলিয়ে দেখার প্রয়োজনও অনুভব করি না। দুধর্ষ বা লোমহর্ষক ঘটনার আকর্ষিকতায় আমরা প্রতিক্রিয়া দেখাতে অভ্যস্ত। এমসি কলেজের ছাত্রাবাস জ্বালিয়ে দেয়ার মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা নিকট অতীতে ঘটেছে। অপরাধীদের ছবি ও অপরাধের চলমান ভিডিও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ সাহেব ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সামনে আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদেছেন। কি হলো, জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ করে ছাত্রাবাস পূন:নির্মান করা হলেও অপরাধীদের বিচার হয়েছে? অথচ তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী আবেগের বশবর্তি হয়ে না কেঁদে যদি তাঁর অবস্থান থেকে অপরাধীদেরকে আইনের আওতায় এনে ন্যায় বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে যথাযথভাবে সচেষ্ট হতেন তাহলে আজকের ইতিহাস ভিন্ন হতো। এই অপরাধীরা গণধর্ষণের মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটানোর সাহসই পেত না।
আবেগ ও বিবেক এক সাথে চলে না। যতই দুধর্ষ খুনী বা ধর্ষক হোক না কেন তারও আইনী সহযোগীতা পাবার অধিকার প্রচলিত আইন ও সংবিধান স্বীকৃত যদি আমরা আইন ও সংবিধান মানি। না মানলে হয়তো জঙ্গলে আমাদেরকে বসবাস করতে হবে। আবার কোন যৌক্তিক কারনে কাউকে আইনী সহযোগীতা না দেয়াও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের রুল ও কোড অনুযায়ী আইনজীবীর স্বীকৃত অধিকার। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করা উচিৎ নয়।
আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আবহমান কাল থেকে চলে আসছে। দিস ইজ পার্ট অব ন্যাচারাল জাস্টিস। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরও আইনী গন্ডির মধ্যে সীমিত অধিকার থাকে, যেমন ফাঁসির আগে শেষ ইচ্ছা জানা, তার নিকটাত্মীদের সাক্ষাত, তওবা করানো ইত্যাদি। যারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের কথা বলছেন বা দাবী জানাচ্ছেন, তারা কি একবারও ভাবছেন এর সূদুর প্রসারী প্রভাব? যদি ব্যাপকভাবে এটা সমাজে চলতে থাকে তখন? অথবা আপনার নিকটাত্মীয় বা দলের বা বলয়ের বিরুদ্ধে যদি এটা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয় তখন? এভাবেই কিন্তু একটা সমাজ অধ:পতিত হয়। আর এভাবে অধ:পতিত হয়ে সমাজের বেসিক ফেব্রিক নষ্ট হয়ে গেলে আপনার দল কেন যে কেউ ক্ষমতায় গেলেও সমাজের সাধারণ শৃঙ্খলাবোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। একটু বিবেক দিয়ে চিন্তা করুন।
“ধর্ষকদের পক্ষে আইনী সহায়তা দিতে কোন আইনজীবী সিলেটে দাঁড়ান নাই” এ খবরে অনেকের কাছে মনে হয়েছে যেন এক বিরাট বিজয় সাধিত হয়েছে! আসলে কি তাই? এখনও তো বিচার শুরু হয়নি। সবে মাত্র গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। যখন ট্র্যায়াল শুরু হবে তখন এই অভিযুক্তদের কোন আইনজীবী না থাকলে আদালতই রাস্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের আইনী সহায়তার জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেবে। কেননা আসামীর আইনজীবী ছাড়া আদালতের পক্ষে নিরপেক্ষভাবে ন্যায় বিচার করা সম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে – ন্যায় বিচার শুধু করলেই হবে না, বরং ন্যায় বিচার করা হয়েছে বলে সবার কাছে দৃশ্যমান হতে হবে। আসামীর আইনজীবী ছাড়া বিচার কার্য চালিয়ে আসামীদের যথাযথ শাস্তি দিলেও আসামীদের পক্ষ থেকে পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট বিচারকের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনা হতে পারে এবং এটি আপীলের অন্যতম শক্ত গ্রাউন্ড হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে। আর এই গ্রাউন্ডের উপর ভিত্তি করে যদি অপরাধীরা উচ্চআদালতে কম শাস্তি পায় বা বেকসুর খালাস পায় তখন অতি আবেগীরা কি করবেন?
আইনজীবীদের প্রথম পরিচয় তারা অফিসারস্ অব দ্য কোর্ট। তারা যুক্তি, তর্ক, আইনের ব্যাখ্যা ও সাবিমিশন দিয়ে মূলত: কোর্ট ও বিচারককে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সহযোগীতা করেন। আর এই আইনী নিয়মের মধ্যেই অপরাধীরা অপরাধী সাব্যস্ত হয় আর নির্দোষরা খালাস পায়। কোন সমাজে বা দেশে এর ভিন্নতা ঘটলে বা থাকলে সেই দেশ বা দেশের কলুষিত সমাজ দায়ী, শ্বাশত: আইনের বিধান দায়ী নয়। আর অতি আবেগ সুন্দর সমাজ বিনির্মানের পরিবর্তে বরং সমাজের কলুষিতাকে আরও বাড়িতে দেয়। তাই আমরা যেমন শাহবাগীদের ন্যায় বিচার ছাড়া “ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই”কে সমর্থন করতে পারি না ঠিক তেমনি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোন অজুহাতেই এনকাউন্টার বা ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করতে পারি না।
আইনের চোখে একজনের দ্বায় বা সাজা অন্যজনকে দেয়া যায় না। তাই যতই দুধর্ষ খুনী বা ধর্ষক হোক তাদের পিতামাতার ছবি অহরহ সোসাল মিডিয়ায় দিয়ে পিতামাতাকে অপমান বা শাস্তির দেয়া বেআইনী। ফেরেশতার মতো পিতামাতার সন্তান কি শয়তানের মত হয় না? কিংবা শয়তানতূল্য পিতামাতার সন্তান কি ফেরেশতাতূল্য হয় না? এর ভূরিভূরি উদাহরণ নবীদের (আ:) থেকে শুরু করে আমাদের সমাজে আছে। সুতরাং আবেগ পরিহার করে বিবেক দিয়ে আইনসম্মত ও ন্যায়ভিত্তিক চিন্তা করুন।
আমি চাই “ডিটারেন্ট থিউরী” এপ্লাই করে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। তবে তা হতে হবে আইনী কাঠামোর ভিতরে ডিউ প্রসেস অনুসরণের মাধ্যমে ন্যায় বিচারের সব উপাদান যথাযথভাবে এপ্লাই করে যাতে করে লাইনে থাকা অপেক্ষমাণ সমান অপরাধীরা ডিটার্ড হয়ে যায়। আর এটা নিশ্চিত করতে পারলে নিম্ন আদালতের কঠোর সাজা উপরেও বহাল থাকবে। নতুবা আবেগের ভিত্তিতে সাজা দেয়া হলে আপীলে কম শাস্তি বা খালাসের সম্ভাবনা থেকে যাবে।
লেখক: বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক ও বিশ্লেষক।