করোনার উপসর্গ নিয়ে বুধবার দিবাগত রাতে মারা যান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নগর পরিকল্পনাবিদ সারোয়ার উদ্দিন আহমেদ। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জানতেই পারলেন না তিনি করোনা আক্রান্ত কিনা। অথচ মৃত্যুর চারদিন আগে সংগ্রহ করা হয়েছিল তার নমুনা।
বৃহস্পতিবার সকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন তার ছোট ভাই রায়হান। তিনি জানান, বুধবার রাতে সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফলেও নেই সারোয়ার উদ্দিন আহমেদের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট।
এ ফলাফলে চট্টগ্রামের ৫৩০ জনের নমুনা পরীক্ষায় ১৪০ জনের দেহে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। এ নিয়ে চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫৩৭ জনে।
রায়হান বলেন, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে পরবর্তী পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হবে। যাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে গত ২৪ ঘন্টায় করোনা সংক্রমণের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কি ঠিক প্রশ্ন করেন রায়হান? বরং পরীক্ষা করা এসব নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে অন্তত ৫-৭ দিন আগে। ফলে করোনা পরিস্থিতির আপডেট তথ্য যেমন উঠে আসছে না, তেমনি রিপোর্ট পাওয়ার আগেই করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুবরণ করছেন অনেকেই।
এদিকে করোনার উপসর্গ নিয়ে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হতে গেলে উল্টো দূর দূর করে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। চাপে পড়ে কোন কোন হাসপাতাল ভর্তি করালেও হয় ভর্তির দিন, না হয় পরেরদিন, কোন কোন ক্ষেত্রে ২-৩দিন পর মারা যাচ্ছে রোগী। আর এরমধ্যেও মিলছে না নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট। বেশিরভাগ রোগী নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়ার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। কেউ কেউ রিপোর্ট পেলেও কয়েক ঘন্টা পর মারা যাচ্ছেন।
রিপোর্ট পাওয়া নিয়ে এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিআইটিআইডি হাসপাতাল ল্যাবের সমন্বয়কারী ডা. শাকিল আহমেদ পরিবর্তন ডটকমকে বলেন, চট্টগ্রামে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। ফ্রান্সের একটি দাতব্য সংস্থা থেকে অনুদান পাওয়া কয়েকটি কিট দিয়ে নমুনা পরীক্ষা শুরু করেছিলাম আমরা। সে হিসেবে শুরু থেকে নমুনা সংগ্রহের তুলনায় পরীক্ষা অনেক কম হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ফলে ল্যাবে নমুনাজট লেগেছে। এতে ৪-৫ দিন আগে জমা হওয়া নমুনা পরীক্ষাও আটকে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, হাসপাতালে যে পরিমাণ নমুনা আসছে তা পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত জনবল নেই। আক্রান্ত বাড়ার সাথে নমুনা পরীক্ষার ল্যাব বাড়লেও সবকটিতে জনবল সংকট রয়েছে। ফলে কাঙ্খিত সময়ে নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এতে করোনা পরিস্থিতি জলঘোলার মত অবস্থায় রয়েছে চট্টগ্রামে।
শাকিল আহমেদ বলেন, সংগৃহীত নমুনা অনুযায়ী জনবল পেলে তা ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রকাশ করা সম্ভব। তবে রিপোর্ট প্রকাশে দীর্ঘসূত্রিতার আরও কারণ রয়েছে। সেগুলো হলো কোন কোন ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পাঠাতেও অনেকটা সময় লাগছে। নগরে তো যেমন তেমন, চট্টগ্রাম বিভাগের অন্য জেলা ও উপজেলাগুলো থেকে নমুনা আনতে সময় লাগছে বেশি।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নমুনা পরীক্ষায় দীর্ঘসূত্রিতার কথা স্বীকার করে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে নমুনা সংগ্রহে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকরা সময়ক্ষেপন করছে। এই সময়ে অনেকে বুঝতে পারছেন না তিনি করোনা আক্রান্ত কি না। আর যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তখন হয়তো আক্রান্ত ব্যক্তি সংকাটপন্ন পর্যায়ে চলে যায়। এই সময় হাসপাতালে ভর্তি হতে চাইলেও বেসরকারি হাসপাতালগুলো ভর্তি নিচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর কোন শয্যা খালি নেই। এতে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে রোগীদের। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সংকট তো রয়েছেই। যেটা করোনা রোগীর শ্বাসকষ্টে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সংখ্যা ৭৯ জন হলেও করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন এমন হিসেবে রয়েছে আরও ৪৭ জন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আরও তিন-চারগুণ বেশি। যাদের অধিকাংশই মৃত্যুর আগে জানতে পারেনি সে আসলেই করোনা আক্রান্ত কিনা।
ওই কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামের আইনজীবী আবুল কাশেম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্বিবিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সাবরিনা ইসলাম সুইটি, চট্টগ্রাম বন্দর চেয়ারম্যানের একান্ত সহকারী, শিল্পপতি মোহাম্মদ ইউনুচসহ অনেকেই করোনার উপসর্গ বা করোনায় আক্রান্ত হয়ে সম্প্রতি মারা গেছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে তারা জানতে পারেননি, তারা করোনা আক্রান্ত কিনা।
চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, নমুনা দিন দিন বাড়ছে। পরীক্ষার সুযোগও বাড়ছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব চালু হচ্ছে। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানও খুব শিগগিরই নমুনা পরীক্ষা শুরু করবে। নমুনা সংগ্রহে বুথ করা হচ্ছে। হতাশ হলে চলবে না। আমাদের সামর্থ্য সীমিত। এ নিয়েই আমাদের করোনা মোকাবিলা করতে হবে।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও নাগরিক উদ্যোগের প্রধান উপদেষ্টা খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু আশার বাণী শুনাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত আইসিইউ নেই। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-ভেন্টিলেটর থাকলেও তারা চিকিৎসা দিচ্ছে না। নমুনা পরীক্ষা নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতায় মরছে মানুষ। ওষুধের দাম বাড়ছে। চট্টগ্রামে কোথাও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।