ব্যারিস্টার নাজির আহমদ :: প্রায় ৩১ বছর হলো আমার লন্ডনের জীবন। আমার জীবনেতো নয়ই, বরং পৃথিবীর দেড় শত কোটি মানুষ এবং তাদের পূর্রসূরীরা জীবদ্দশায় কখনো এমন রমজান ও ঈদ তারা কখনও পাননি বা দেখেননি। বস্তুত: আমরা জীবিত সবাই এবারের ব্যতিক্রমধর্মী রমজান ও ঈদ পালনের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এক ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম।
এবারের রমজান
বিশ-এর কোটার ঠগবগে যুবক হিসেবে আশির দশকের শেষের দিকে বিলেতে আমার আগমন। পড়াশুনায় বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রফেশনাল বডির কোর্সে কাঠালাম এক দশক। এরপর প্রফেশনাল হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু। পড়াশুনার সময়েও কমিউনিটি সম্প্রিক্ততা ছিল। রমজানে তখন অনেক ইফতার মাহফিল নিজে আয়োজন করতাম এবং অগনিত ইফতার মাহফিলে শিখার জন্য নিজে শ্রোতা হিসেবে যোগদান করতাম। পরবর্তীতে প্রফেশনাল প্র্যাকটিস শুরু করার পর যখন কমিউনিটিতে পরিচিতি হলো তখন আসতে লাগল ইফতার মাহফিলের দাওয়াত আর দাওয়াত। সম্প্রতি পাবলিক প্রতিনিধি হিসেবে দাওয়াতের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। রমজানের প্রতিদিন কমপক্ষে ৪/৫টি ইফতার মাহফিলে অতিথি হিসেবে দাওয়াত থাকতো। না গিয়েও উপায় নাই! ঐ বছরগুলোতেও নিজ বাসায় ফ্যামিলির সাথে ইফতার করা ছিল অনেকটা দুরূহ ব্যাপার।
কিন্তু এবারের রমজান ছিল সম্পূর্ন আলাদা। কোথাও কোন ইফতার মাহফিলের আয়োজন নেই, নেই কোন দাওয়াত। নেই অতিথি হিসেবে কোথাও যাবার তাড়া। তিরিশটি রমজানের সব কটির ইফতার বাসায় স্ত্রী ও বাচ্চাদের সাথে অত্যন্ত নিরিবিলি ও অন্তরঙ্গভাবে করার সুযোগ হয়েছে। শুধু আমি নয় বরং সবার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়েছে। করোনাভাইরাসের মহামারীর কারনে লকডাউন অবস্থায় রমজান না হলে এটা কখনও সম্ভব হতো না!
সত্যিই রমজান এলে পুরো দেশ জুড়ে কমিউনিটিতে ইফতার পার্টির বা মাহফিলের সাজসাজ রব শুরু হত।এটা অনেকটা রেওয়াজে পরিনত হয়েছিল। আর এসব ইফতার পার্টিগুলোতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অনেক খাবার অযথা নষ্ট হতো। এতে হাজার হাজার পাউন্ড, এমনকি লক্ষ লক্ষ পাউন্ড অপচয় হতে দেখেছি। অথচ এত ঢাকঢোল পিটিয়ে ইফতার পার্টির আয়োজন না করে এই টাকাগুলো গরীব, অসহায় ও নি:স্ব লোকদেরকে দিলে মহান প্রভূর আরশ খুশী হয়ে যেত। কোন ধরনের বিলাসী ইফতার পার্টির আয়োজন ছাড়া যে কত সুন্দর রমজান মাস পার হতে পারে এবারের রমজান মাস আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। আমাদের হৃদয়াঙ্গম কি হবে? খুলবে কি আমাদের চোখ?
তবে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে গোটা রমজানে মসজিদে গিয়ে জামায়াতে নামাজ ও তারাবী আদায় করতে না পারার কারনে। বিশেষ করে প্রতি রমজানে লন্ডন মুসলিম সেন্টার (এলএমসি) থাকতো সরগরম। একসাথে ৮-১০ হাজার মানুষ এশা ও তারাবীর নামাজ আদায় করতেন। এলএমসি’র আঁশেপাশে কাবা শরীফের একটি মিনি আমেজ পাওয়া যেত বা বিরাজ করতো। মুসল্লিদের এত উপসে পড়া ভিড় থাকতো যে প্রথম ১০ রাত আগেবাগে নামাজে না গেলে জায়গাই পাওয়া যেত না। এই অবস্থা ছিল মোটামুটি বিলেতের সব কটি মসজিদে।
কিন্তু এবার ছিল সম্পূর্ন বিপরিত চিত্র। সব মসজিদ বন্ধ। রাস্তাঘাটের মত মসজিদের আশেপাশের অবস্থা ছিল জনমানব শুন্য, অনেকটা ভূতুরে। সবার মত নিজ ঘরেই পরিবারের সবাইকে নিয়ে জামায়াতে সব নামাজ ও তারাবী আদায় করেছি। তবে এবারের রমজান প্রায় প্রত্যেক ঘরে ঘরে জামায়াত কায়েম করেছে এবং এক একজন ইমাম সৃষ্টি/তৈরী করেছে! নি:সন্দেহে হৃদয়ে রক্তক্ষরনের মাঝেও এটি একটি ইতিবাচক দিক।
এবারের ঈদ
এবারের ঈদটা চলে গেল একেবারে নীরবে, নিস্তব্ধে। ঈদের কোন বাজার বা কেনাকেটা নেই যেহেতু লকডাউনে দোকানপাট ছিল বন্ধ। বাইরে ঈদের জামায়াত পড়ার কোন সুযোগই ছিল না যেহেতু মসজিদ ও পার্ক ছিল বন্ধ। ঈদের জামায়াততো দূরের কথা, যে কোন ধরনের জমায়েত ছিল নিষিদ্ধ। তাই বাধ্য হয়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে বাসার ভিতর ছয় তাকবীরের সাথে খুতবা ছাড়া ঈদের নামাজ আদায় করলাম।
এ ধরনের বিশেষ অবস্থায় যে ঘরের মধ্যে ঈদের জামায়াত পড়া যায় এটা অনেকের এমনকি অনেক আলেমেরও জানা ছিল না। সত্যি কথা বলতে কি কোন সমস্যার সৃস্টি না হলে বিকল্প চিন্তা বা সমাধানের পথ বের হয় না বা পথ কেউ খোজেও না। অথচ এ ব্যাপারে বুখারী শরীফের সহিহ হাদিস আছে। আনাস (রা:) শেষ জীবনে ইরাকের বসরা নগরীতে থাকতেন। একদিন কোন কারন বশত: উনি এবং উনার পরিবার ঈদের নামাজ জামায়াতে পড়তে পারেননি। যার ফলে উনি বাসায় এসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এক সাথে ঈদের সালাত ঘরের মধ্যেই আদায় করে নেন।(বুখারী ১/১৩৪)। আনাস (রা) আমাদের প্রিয় নবীর (স:) খুব কাছের সাহাবী ছিলেন যাকে বলা হত “খাদেমু রাসুলুল্লাহ”। তিনি ১০ বছর রাসুল (স:) এর খেদমত করেছেন। তিনি মহানবীর (স:) চিন্তা ও চেতনা সম্পর্কে ভাল ধারনা রাখতেন এবং এর পেক্ষাপটে তিনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এই দলিলের আলোকে বেশীর ভাগ স্কলার বলছেন ঈদের নামাজ কোন বিশেষ কারন বশত: ঘরে পড়া যাবে। যেহেতু বর্তমান মহামারীর কারনে সরকারিভাবে ঘোষিত লকডাউনে মসজিদ বন্ধ, আমরা কেউ ঈদগাহে বা পার্কে যেয়ে নামাজ পড়তে পারছি না সেহেতু আনাস (রা) – এর আমল অনুসারে কিয়াস করে বেশীরভাগ ফকিহ ঘরে ঈদের নামাজ আদায়ের সুন্দর সমাধান দিয়েছেন।
তবে হ্যাঁ, বড় মসজিদে বা পার্কে ঈদের জামায়াতে অংশ নেয়ার মজাই আলাদা। এতে শত শত, হাজার হাজার লোকদের সাথে কোলাকুলি করে ও পারস্পরিক ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে যে মজা পাওয়া যায় তা সত্যিই অতুলনীয়। বেশ কয়েক বছর ধরে লন্ডনের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে আবহাওয়া ভাল থাকলে বড় পার্কগুলোতে বড় বড় ঈদের জামায়াতের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এসব বড় জামায়াতগুলোতে বাচ্চাদের নিয়ে যোগদান সত্যিই নির্মল আনন্দ দেয়। এবার এটি মিস্ করলাম।
কমিউনিটির বিভিন্ন মিটিং, সোসাল এন্গেইজমেন্টে ও রাস্তাঘাটে অনেকের সাথে সাক্ষাত হত তাদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোক এই মহামারীতে ইতিমধ্যে এই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। তাদের প্রত্যেকের পরিবারের জন্য এবারের ঈদ আনন্দের ছিল না। বর্তমান অবস্থায় মৃত কারো জানাযায় শরীক হওয়া সম্ভব হয়নি। দোয়া করি মহান মা’বুদ যেন তাদের সবাইকে তাঁর হাবীবের (স:) সহিহ হাদিস অনুযায়ী শাহাদতের মর্যাদা দান করেন।
পরিশেষে বলবো আমরা আর এমন রমজান ও ঈদ চাই না যখন মসজিদগুলো থাকবে বন্ধ। আমাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে এবার সত্যি। তবে আর আমরা জরুরী অবস্থায় চাই না রমজান ও ঈদ। আমরা চাই এগুলো স্বাভাবিক অবস্থায়। মহান মা’বুদের কাছ বিনীত প্রার্থনা তিনি যেন সত্বর তাঁর কুদরত দিয়ে আমাদেরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যান। আ-মীন।
লেখক: বৃটেনে প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, বিশ্লেষক, চিন্তাবিদ ও নিউহ্যাম বারার ডেপুটি স্পীকার।