ব্যারিস্টার নাজির আহমদ
প্রফেসর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহ:) অত্যন্ত জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, বিচক্ষন, ধীশক্তিসম্পন্ন ও ভারসাম্যপূর্ন উচুঁমানের আলেম ও স্কলার ছিলেন। এই মানের আলেম বা স্কলার বাংলাদেশে একেবারেই হাতে গুনা। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষাবিদ, টিভি ব্যক্তিত্ব, সুলেখক, পরমতসহিষ্ণু ধীমান আলেম, গবেষক, ওলামাদের ঐক্যের কাঙ্গাল, ভারসাম্যপূর্ন আলোচক ও সমাজ সংস্কারক। টিভিতে তিনি কথা বলতেন আবেগহীন সাবলিল ভাষায়, সঠিক তথ্য ও যুক্তি দিয়ে, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এবং সর্বোপরি দরদভরা মন নিয়ে। কাউকে কঠাক্ষ করে বা হেয় করে কোন দিন তাঁর কোন কথা শুনিনি। বাংলাদেশে হাদিসের অনেক শাইখ, শিক্ষক ও উস্তাদ আছেন। কিন্তু তাঁর মত উঁচুমানের হাদিস বিশারদ ও গবেষক চোখে পড়ে না।
স্বর্নোজ্জল একাডেমিক ক্যারিয়ার ছিল তাঁর:
ছাত্র জীবনে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রচন্ড মেধাবী ছিলেন। এই প্রখর মেধার সাক্ষ্যর তিনি বাংলাদেশ ও সৌদি আরব দু’জায়গায়ই রেখেছেন। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন মাদ্রাসা ঢাকা আলিয়া থেকে দাখিল, আলীম ও ফাজিল কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করার পর মাদ্রাসা লাইনের সর্বোচ্চ ডিগ্রী তথা হাদিসে বিভাগে মুনতাজুল মুহাদ্দিসীন (এম.এম) কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। এই ডিগ্রীকে বাংলাদেশে কামিল হলা হয়। এটি পাশের পর বাংলাদেশে সাধারনত “মাওলানা” টাইটেল দেয়া হয় বা নামের আগে এই টাইটেলে ডাকা হয়। কামিলে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর প্রথম শ্রেনীতে মেরিট লিস্টে অষ্টম স্থান অধিকার করেন।
এরপর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর উচ্চ শিক্ষার জন্য সৌদি আরবের রিয়াদে অবস্থিত খ্যাতিমান বিশ্ববিদ্যালয় তথা ইমাম মুহম্মদ বিন সাউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। সেখান থেকে ১৯৮৬ সালে অনার্স, ১৯৯২ সালে মাস্টার্স ও ১৯৯৮ সালে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। রিয়াদে অধ্যয়নকালে বর্তমান সৌদির বাদশা ও তৎকালীন রিয়াদের গভর্নর জনাব সালমানের কাছ থেকে পর পর দু’বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হিসেবে পুরস্কার লাভ করেন। চিন্তা করতে পারেন – এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত অর্ধ লক্ষাধিকের উপরে ছাত্র পড়াশুনা করেন। হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র সৌদি আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আসেন পড়তে যাদের মাতৃভাষা আরবী। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে গিয়ে একজন ছাত্র দুই দুই বার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হিসেবে পুরস্কার পাওয়া চাট্রিখানি কথা নয়! সৌদি আরবে পড়াকালীন সময়ে ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বিশ্বের খ্যাতিমান ও বরেন্য ইসলামিক চিন্তাবিদ ও স্কলারদের সান্নিধ্যে এসেছেন।
এমন সেরা ছাত্রের চমৎকার ফলাফল ও সর্বোচ্চ রিসার্চ ডিগ্রী নেয়ার পর সৌদি আরবে তাঁর জন্য অনেক উঁচু, সম্মানজনক ও লোভনীয় সুযোগ ছিল। কিন্তু এগুলো উপেক্ষা করে দ্বীনের প্রচার ও সমাজ সংস্কারের জন্য বাংলাদেশে চলে আসেন। এসে ১৯৯৮ সালে কুষ্টিয়া ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আল-হাদিস ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে একই বিভাগে প্রফেসর হিসেবে উন্নীত হন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন দিকের উপর তিনি প্রায় অর্ধ শতাধিক বই লিখেছেন যার বেশীরভাগ মৌলিক ও গবেষণাধর্মী।
তাঁর দুটি কালজয়ী গ্রন্থ:
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহ:) এর “হাদিসের নামে জালিয়াতি: প্রচলিত মিথ্যা হাদিস ও ভিত্তিহীন কথা” শীর্ষক ৬৭২ পৃষ্টার বিশাল বইটি লাইন বাই লাইন ও ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। এক কথায় বইটি অসাধারন। আমার মনে হয় বাংলাদেশের তাবৎ আলেম সমাজ এবং ওয়ায়েজদের এই মূল্যবান বইটি ভাল করে পড়া দরকার। এটি একটি অত্যন্ত উঁচুমানের গবেষণাপ্রসূত বই যার পরতে পরতে আছে রেফারেন্স। আছে গ্রন্থসূচীতে (Bibliography’তে) ২৭৩টি বইয়ের তালিকা। আহা, কত কথা আমরা যুগের পর যুগ হাদিস হিসেবে শুনে আসছি। ওয়ায়েজরা গলার সুর দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক কথা হাদিস নামে দেদারছে চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এগুলোর বেশীরভাগই ভিত্তিহীন কথা, শুনা কথা বা হাদিসের নামে জালিয়াতিমূলক কথা। এ ধরনের শত শত এমন কি হাজারও উদাহরণ এই বইতে আছে। বইটি পড়ে বুক কেঁপে উঠে এই ভেবে যে জেনে বা না জেনে আমরা (সাধারন মানুষ, এমনকি বেশীরভাগ আলেমও) কত ফালতু কথা বা মিথ্যা কথা অথবা জাল কথা আমাদের প্রিয় নবীর (স:) নামে চালিয়ে যাচ্ছি!
আমি সব সাধারন শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, বিভিন্ন প্রফেশনাল ও আলেম সমাজকে এই বইটি পড়ার উদাত্ত্ব আহবান জানাই। বিশ্বাস করুন – এ বইটি পড়লে আপনার চোখ খুলে যাবে। আসুন সহিহ হাদিসগুলো আমরা চিনি, জানি ও মানি। তার সাথে সাথে আমাদের প্রিয় নবীর (স:) নামে মিথ্যা ও জাল এবং বানোয়াট কথা বলা ও ছড়ানো থেকে বিরত থাকি। পুরো নিশ্চিত না হয়ে কোন কথা অন্তত: হাদিস হিসেবে আমরা বলব না বা চালাবার চেষ্টা করব না। চিন্তা করুন, আমাদের নিজেদের ব্যাপারে বা আমাদের মা-বাবার ব্যাপারে কেউ ডাহা মিথ্যা বললে বা ছড়ালে আমরা কিভাবে রিয়েক্ট করি? ভাবতে পারেন, মহান প্রভুর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেস্ট নবীর (স:) ব্যাপারে মিথ্যা ছড়ালে বা মিথ্যা তমক দিলে তার পরিনাম কি হতে পারে? মহান প্রভু আমাদেরকে সঠিক সমুজ দান করুন।
ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহ:) এর আরেকটি কালজয়ী গ্রন্থ “রাহে বেলায়াত”। বিশাল এ বইটি ৬৫৬ পৃষ্টার। সূচী, ভূমিকা ও প্রথম ৫০ পৃষ্টা পড়েই বুঝা যাবে যে বইটি কি চমৎকার এবং আমাদের জন্য কত দরকারী। আজে বাজে কত রকমের যিকির আমরা সারা জীরন দেখে আসছি এবং করে আসছি। অথচ এগুলোর বেশীরভাগই মনগড়া, বানানো ও কোরআন-সুন্নাহ সমর্থিত নয়। এই বইতে লেখক চমত্কারভাবে মহান আল্লাহপাকের নৈকট্য অর্জনের সঠিক পথ ও মহানবীর (স:) যিকিরগুলো সুন্দর করে দালিলিকভাবে উল্লেখ করেছেন ও আলোচনা করেছেন। তিনি দলীলসহ বর্ননা করেছেন আমাদের প্রিয় নবী (স:) ও সাহাবায়ে কেরামগন (রা:) কিভাবে, কখন, কতবার ও কী কী বাক্য দ্বারা যিকির করতেন, সুবহানাল্লাহ। এর চেয়ে বড় উপকারী বই আর কি হতে পারে! আফসুস্, সহিহ হাদিস ও সুন্নাহ সম্মত এত সুন্দর সুন্দর যিকির থাকার পরও আমরা অনেকে অনেক সময় অর্থহীন, অসম্পূর্ণ এবং ভিত্তিহীন কথার যিকির নিয়ে ব্যস্ত থাকি ও বাড়াবাড়ি করি।
ইসলাম কত সুন্দর, সহজ, ন্যাচারাল (প্রাকৃতিক) ও বাস্তব জীবন ব্যবস্থা। কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক কত সুন্দর সুন্দর আমল আমরা সহজেই করতে পারি। কিন্তু কিছু ব্যক্তি ও ওয়ায়েজ খামোখা ইসলাম ও এর ভিতরের আমলগুলোকে সাধারন মানুষের কাছে কঠিন ও জটিল করে তুলছেন। যেমন ধরুন – এই বা ঐ বিশেষ বিশেষ রাতে এত এত রাকাত নামাজ পড়তে হবে। প্রতি রাকাতে ২৫ বার, ১০০ বার সুরা এখলাস পড়ার নিয়ম করে দেয়া। এবার চিন্তা করুন – নামাজের ভিতর এক রাকাতে ২৫ বা ১০০ বার সুরা এখলাস পড়েছি কি না তা মনে রাখা বা হিসেব রাখা কি সহজ ব্যপার? অথচ সহিহ হাদিসে এগুলোর কোন ভিত্তিই নেই। তাছাড়া “নাওয়াইতুআন…….” নামক লম্বা আরবী বাক্য দিয়ে নামাজের নিয়্যত করা বা লম্বা অন্যান্য আরবী বাক্যাবলী দিয়ে রোজার বা ওজুর নিয়্যত করা সাধারন মানুষের জন্য কত কঠিন! এই গতবাঁধা আরবী নিয়্যত জানে না বলে অনেক মানুষ নামাজেই যেতে চায় না! চিন্তা করতে পারেন! অথচ এগুলোর কোন ভিত্তি কোন সহিহ হাদিস বা সুন্নাহ’তে নেই। নিয়্যত তো অন্তরের ব্যাপার এবং তা কোন ভাষা মুখে না আওরিয়ে মুহুর্তের মধ্যেই করা যায়। এভাবে সহজ ইসলামকে কঠিন ও জটিল করার ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া যাবে। আফসুস্!
চার বছর আগে ২০১৬ সালের মে মাসের আজকের এই দিনে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় এই মনীষী মাত্র ৫৫ বছর বয়েসে পৃথিবী ছেড়ে মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যান। তাঁর মৃত্যুতে দেশের বিশেষ করে ইসলামিক অঙ্গনের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। দেশ একজন ক্ষনজন্মা পুরুষ ও প্রজ্ঞাবান দা’য়ী এবং ধীশক্তিসম্পন্ন সমাজ সংস্কারকে হারাল। তাঁর এই ধরায় আগমন ও চলে যাওয়া যেন অনেকটা উল্কার মত। এত অল্প সময়ে তাঁর ভারসাম্যপূর্ন আচরনে, গবেষনায়, লিখায় ও বলায় আমাদেরকে যা দিয়ে গেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়।
দাঁত থাকতে আমরা দাঁতের মজা বা গুরুত্ব বুঝি না। ঠিক তেমনি ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রাহ:) জীবিত থাকতে তাঁর কদর ও গুরুত্ব আমরা তেমন বুঝিনি। এখন তাঁর অনুপস্থিতি ইসলামি অঙ্গন হাড়েনাড়ে উপলব্ধি করছে। তাঁর মাপের ও ক্যালিবারের ভারসাম্যপূর্ন কয়েক ডজন আলেম বাংলাদেশে থাকলে দেশের ইসলামি অঙ্গন ও সমাজের চেহারাটা পাল্টে যেত। বস্তুত: ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের (রাহ:) ইন্তেকালের পর আমি তাঁকে আবিষ্কার করি! জীবনে কোন দিন তাঁর সাথে সাক্ষাত হয়নি। আর কোন দিন এই জগতে সাক্ষাতের কোন সুযোগ নেই। তাঁর বইগুলো আর ইউটিউবে তাঁর কথাগুলো/আলোচনাগুলো শুনে তাঁর জন্য অন্তর থেকে দোয়া আসে। হে মহান মাবুদ, তোমার এই বান্দাকে জান্নাতুল ফিরদাউসের মেহমান বানিয়ে সর্বোচ্চ সম্মান তাঁকে দাও। আ-মীন।
এই যুগশ্রেষ্ট ও ভারসাম্যপূর্ন মনীষী ও আলেমের জীবন ও কর্মের উপর উচ্চমানের গুনগত গবেষনা হওয়া প্রয়োজন। তাঁর চিন্তাধারা ও এপ্রোচের উপর পিএইচডি ও পিএইচডি-উত্তর (post-doc) মানের থিসিস হওয়া অত্যাবশ্যকীয় আমাদের জন্য, দেশের জন্য ও পর্বোপরি মুসলিম উম্মাহর জন্য। তার পাশাপাশি তাঁর সবগুলো বই অন্যান্য ভাষায় বিশেষ করে ইংরেজী ভাষায় অনুবাদ হওয়া দরকার সাধারন শিক্ষিত নতুন প্রজন্মকে শিরক ও বেদায়াতমুক্ত কোরআন ও সহিহ হাদিসসম্মত এবং সুন্নাহ ভিত্তিক আকিদা পোষনে ও আমলে উদ্বোদ্ধ করার জন্য।
লেখক: বৃটেনের প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী, কমিউনিটির সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, গবেষক, চিন্তাবিদ ও নিউহ্যাম বারার ডেপুটি স্পিকার।