বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে রাজি হয়েছেন বলে জানা গেছে। তাঁর জামিন আবেদনের ওপর আগামীকাল বৃহস্পতিবার শুনানি হওয়ার কথা। তবে ‘দোষ স্বীকার’ করে প্যারোল (শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি) চাইতে তিনি রাজি হবেন কি না, সে বিষয়ে বিএনপি এখনো নিশ্চিত নয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সমঝোতা বা প্যারোলের ব্যাপারে প্রায় দুই বছর ধরেই রাজি হচ্ছিলেন না খালেদা জিয়া। এমনকি প্রথম দিকে বিএনপির নেতারা এ বিষয়ে তাঁর কাছে উপস্থাপন করারও সাহস পাননি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা অবনতি হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা শঙ্কিত হয়ে পড়েন। পাশাপাশি বিএনপি নেতারাও ভয় পেয়ে যান। বক্তব্য-বিবৃতিতে তাঁরা এমন অভিযোগও করেন যে সরকার কারাগারেই খালেদা জিয়াকে মেরে ফেলতে চায়। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের পক্ষ থেকে নানাভাবে খালেদা জিয়াকে বোঝানো হয়, রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ যা-ই হোক না কেন, আপাতত উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন।
পরিবারের সদস্যদের মতে, খালেদা জিয়া বেঁচে থাকলে রাজনীতিতে সুদিন আবার আসতেও পারে। উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে রাজি করাতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকেও নানাভাবে খালেদা জিয়ার কাছে বার্তা পাঠানো হয়। বলা হয় যে তিনি (খালেদা জিয়া) কারামুক্ত হলে বিএনপিতেই নতুন করে আশার আলো সঞ্চার হবে। কেউ কেউ তাঁর অনুপস্থিতিতে বিএনপির দুরবস্থার কথাও জানান খালেদা জিয়াকে। সূত্রের দাবি, নানা দিক থেকে এমন পরামর্শে খালেদা জিয়া লন্ডনে চিকিৎসার ব্যাপারে রাজি হয়েছেন। আর এ ব্যাপারে প্রয়োজন হলে পর্দার আড়ালে সমঝোতার ব্যাপারেও তিনি নমনীয় হয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিএনপি আশা করছে, যথাযথ চিকিৎসা এবং মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনের জামিন মিলবে। তবে তিনি প্যারোল নেবেন কি না, সে বিষয়টি পুরোপুরি পরিবারের এখতিয়ার।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্যারোলের বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে আমি কোনো কথা বলিনি।’
দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আপাতত আমরা জামিনের প্রত্যাশা করছি এবং মনে করি যে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হবে। আর জামিন না হলে কী হবে, সে বিষয়ে এখনই বলা যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন গত সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জামিন হলে তো আর প্যারোলের প্রয়োজন হবে না।’ তিনি বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন প্যারোল নেবেন কি না, সেটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। এটি তাঁর পরিবার ভালো বলতে পারবে।’
খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘জামিন না হলে কী হবে, সেটি পরের বিষয়। এখনই এ ব্যাপারে বলা সম্ভব নয়।’
সূত্র মতে, দলীয় প্রধানের মনোভাব টের পেয়েই গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে ফোনে খালেদা জিয়ার মুুক্তির বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুরোধ করেন। যদিও ওবায়দুল কাদের এ বিষয়ে নিষ্পত্তির জন্য আদালতের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
তবে দুই নেতার মধ্যে সেদিন যে কথোপকথন হয় তার মধ্যে ‘দোষ স্বীকার করে’ প্যারোলের বিষয়টি উল্লেখ আছে। ফখরুলের সঙ্গে টেলিফোন আলাপে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আদালতই আপনাদের শেষ রাস্তা। আরেকটি রাস্তা আছে যে প্যারোল চাইতে হলে আইন অনুযায়ী তাঁকে দোষ স্বীকার করে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। প্যারোলের আবেদন আসলে সরকার বিষয়টি ভেবে দেখবে। আমাদের গণ্ডির মধ্যে থাকতে হবে…। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
অবশ্য ২০১৬ সালের ১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রণীত নীতিমালা ‘দোষ স্বীকারে’র কোনো শর্ত উল্লেখ নেই। নীতিমালার ২ নম্বরে উল্লেখ আছে, ‘ভিআইপি বা অন্যান্য সকল শ্রেণীর কয়েদী বা হাজতী বন্দিদের নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ কিংবা সরকারের বিশেষ সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। তবে উভয় ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও দূরত্ব বিবেচনায় প্যারোল মঞ্জুরকারী কর্তৃপক্ষ সময়ে নির্ধারণ করে দেবেন।’
প্যারোলের বিধান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিমালায় দোষ স্বীকারের কোনো ব্যবস্থা নেই। তা ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন তো দণ্ডিত। সেখানে দোষ স্বীকার করলে তো ওনার মামলাই থাকে না।’ তিনি বলেন, ‘প্যারোলে মুক্তি হলো একটি ত্বরিত ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১(১) অনুযায়ী আবেদনে মুক্তি এবং প্যারোলে মুক্তি উভয় ক্ষেত্রে সাজা স্থগিত থাকে।’