রুহুল হকচিকিৎসক আ ফ ম রুহুল হক স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকার পাঁচ বছরে তাঁর স্ত্রী ইলা হকের সম্পদ ৭৮২ শতাংশ বেড়েছে। বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছেন একমাত্র ছেলে জিয়াউল হক।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ২০০৮ সালের ও বর্তমান (২০১৩) হলফনামায় দেখা যায়, পাঁচ বছরের ব্যবধানে রুহুল হকের চেয়ে তাঁর স্ত্রীই বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। ছেলে চাকরি ছেড়ে ওষুধ ও আন্তর্জাতিক টেলিফোন কলের ব্যবসায় ঢুকেছেন।
রুহুল হক ব্যবসা থেকে নিয়মিত আয় করেন। মন্ত্রী হওয়ার আগে ব্যবসা থেকে বছরে তাঁর আয় ছিল ২২ লাখ ৫৬ হাজার ১০০ টাকা। মন্ত্রী থাকার পরও তিনি ব্যবসা থেকে একই আয় দেখিয়েছেন।
বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, রাষ্ট্র মন্ত্রীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়। মন্ত্রী হিসেবে রুহুল হক কোনো ব্যবসা করতে পারেন না, ব্যবসা থেকে আয়ও নিতে পারেন না। এটা সংবিধানের পরিপন্থী।
২০০৮ সালে জাতীয় সংসদে সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হন রুহুল হক। আওয়ামী লীগপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিব) সভাপতি রুহুল হক পাঁচ বছর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরে চিকিৎসক ও কর্মচারী নিয়োগে ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে, নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে ডজনের ওপর বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দেওয়া হয়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকারি হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয় চিকিৎসাযন্ত্র কেনা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসা করে এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে ২০১০ সালে ব্যবসায় যুক্ত হয় সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পরিবার।
ফুলে-ফেঁপে উঠছে সম্পদ: ২০০৮ সালের হলফনামায় রুহুল হক বলেছিলেন, তাঁর স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ৯৫ লাখ ছয় হাজার টাকা। ২০১৩ সালের হলফনামায় বলছেন, স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য আট কোটি ৩৯ লাখ ২০ হাজার ৯৯৯ টাকা। পাঁচ বছরে তাঁর স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে ৭৮২ শতাংশ।
তবে এই সময়ে অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ ১১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৮ সালে ছিল তিন কোটি ৬৯ লাখ ২০ হাজার ৬৮৪ টাকা। ২০১৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় সাত কোটি, ৭৭ লাখ, ৭২ হাজার ৩৮৫ টাকা।
রুহুল হক এখন তাঁর নির্বাচনী এলাকা সাতক্ষীরায় আছেন। হলফনামায় দেওয়া নিজের ও স্ত্রীর সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সব কাগজপত্র না দেখে মন্তব্য করা যাচ্ছে না। অর্থের পরিমাণ শুনে মনে হচ্ছে, কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে। হলফনামা থেকে সরাসরি পড়ে শোনানোর পর তিনি বলেন, তাঁর হয়ে যাঁরা হলফনামা পূরণ করেছিলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ভুল করেছেন।
দেনার স্বভাব: অন্যান্য সহায়-সম্পদের কথা বাদ দিলেও ২০০৮ সালে রুহুল হকের ব্যাংকে জমা ছিল ৮৭ লাখ ৭২ হাজার ৭৮ টাকা। ২০০৮ সালের হলফনামায় রুহুল হক বলেছিলেন, নির্বাচনে তাঁর ১৪ লাখ টাকা ব্যয় হতে পারে। নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করার জন্য চাকরিজীবী ছেলের কাছ থেকে তিনি এক লাখ টাকা ধার করতে পারেন।
২০১৩ সালের হলফনামায় দেখা যায়, স্ত্রী ইলা হকের কাছে তিনি এক কোটি টাকা দেনা আছেন।
ছেলের ব্যবসা: নগদ অর্থ ও প্রচুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও রুহুল হকের পরিবার সরকারের কাছে ৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রেখেছে। অভিযোগ আছে, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ২০১২ সালের এপ্রিলে রুহুল হক মস-৫ টেল নামের একটি আন্তর্জাতিক গেটওয়ে (আইজিডব্লিউ) প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নিয়েছিলেন। ছেলে জিয়াউল হক প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক। স্ত্রী ইলা হকও প্রতিষ্ঠানের অংশীদার। নিবন্ধন নবায়ন ও রাজস্ব বাবদ এই প্রতিষ্ঠান ৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকা বকেয়া রেখেছে। টাকা আদায়ের জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন প্রতিষ্ঠানটিকে নোটিশও দিয়েছে। সপ্তাহ খানেক আগে জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেছিলেন, যথাসময়ে বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
সরকারের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে পাওয়া কাগজপত্রে দেখা যায়, ২০১১ সালের ৩ জুলাই জিয়াউল হক প্রতীতী নামে একটি ওষুধ কোম্পানি কিনেছিলেন। মধ্যস্থতা করেছিলেন এমন একজন ফার্মাসিস্ট প্রথম আলোকে বলেন, ওষুধ কোম্পানিটি বিক্রি হয়েছিল ১৪ কোটি টাকায়। জিয়াউল হক নাম পাল্টে ‘এ্যাস্ট্রা বায়োফার্মাসিউটিক্যালস’ রেখেছেন।
এ ব্যাপারে জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বৈধভাবে ব্যবসা করছেন। এ জন্য তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১১ সালের মার্চে বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৬২টি ওষুধ কোম্পানি বন্ধ করে দেওয়ার সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে নিম্নমানের তালিকায় থাকা ওষুধ কোম্পানিটি কেনেন জিয়াউল হক। এই কোম্পানির ওষুধ ঢাকায় বিক্রি হয় না। বিশেষজ্ঞদের প্রবল আপত্তির মুখে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর যে গুটি কয়েক প্রতিষ্ঠানকে ভায়াগ্রা তৈরির অনুমতি দিয়েছিল, তার মধ্যে এ্যাস্ট্রাও আছে।
উৎসঃ প্রথম আলো