‘যারা এতোদিন যাবৎ দলের ভেতরে গ্রুপ উপগ্রুপে বিভক্তি, কলহ-বিষোদগার ও নেতৃত্ব চালিয়ে আসছিলেন তাদের এবার ‘উচিৎ শিক্ষা’ দিয়ে দিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মেয়র পদে সুপার চমক দিয়ে মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে নৌকায় মনোনয়ন দিলেন। এরমাঝেই আছে দলীয় গ্রুপ-উপগ্রুপ, ক্যাডারবাজির লাগাম টেনে ধরতে নেতাকর্মীদের প্রতি শেখ হাসিনার কড়াকড়ি ধরনের মেসেজ (বার্তা)। চট্টগ্রাম মহানগরীতে পানিবদ্ধতা, ভাঙাচোরা সড়ক রাস্তাঘাটের সমস্যা, সমন্বয়ের অভাব, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ হরেক নাগরিক দুর্ভোগ এবং সরকারের উন্নয়নের সুফল থেকে চাটগাঁবাসী অনেকটাই বঞ্চিত হওয়ার পেছনে মূলত দায়ী ‘যত নেতা তত গ্রুপে’র মধ্যকার আর্থ-স্বার্থের লড়াই’।
‘এসব বিরোধ আর দলাদলির বাইরে পরিচ্ছন্ন ইমেজ নিয়ে থাকা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়র পদে নৌকায় মনোনয়ন পাওয়া মানে- একজন ভদ্র-মার্জিত, মিতভাষী, সৎ, সুশিক্ষিত, দীর্ঘদিনের ত্যাগী ও পরীক্ষিত মাঠের নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধার যথার্থ মূল্যায়ন। যিনি চট্টগ্রাম নগরীর বনেদী পরিবারের সন্তান’। গতকাল রোববার চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কয়েকজন মধ্যমসারির নেতার সঙ্গে আলাপকালে তারা উপরোক্ত মতামত ও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
সবসময়ই রাজনীতি-সচেতন চাটগাঁবাসী। রাজনৈতিক অভিজ্ঞজনেরা জোরালো অভিমত দিয়েছেন, চট্টগ্রামে সুস্থধারার রাজনীতি চর্চার গুরুত্বটি সামনে চলে এসেছে রেজাউল করিম চৌধুরীর মূল্যায়নের ফলে। মেয়র পদে নৌকায় তার মনোনয়ন তদবির ও গৎবাঁধা নয়; বরং প্রচলিত ছকের বাইরে। তিনি মিডিয়ায় আলোচনায়ও ছিলেন না। এর মধ্যদিয়ে ইতিবাচক ধারায় রাজনীতির নয়া মেরুকরণের আভাস মিলছে। সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগের জন্য তা যেমনটি ইতিবাচক, ঠিক তেমনি সরকারের বাইরে থাকা বিএনপিসহ অন্যান্য দল-জোটের জন্যও শুভ ফলাফল বয়ে আনবে নিঃসন্দেহে।
গতকাল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেছেন, তিনি নেত্রীর সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছেন। নৌকার বিজয়ের লক্ষ্যে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান। তিনি চট্টগ্রাম নগরবাসীর কাছে যে ভালোবাসা, দোয়া ও সমর্থন পেয়েছেন এরজন্য কৃতজ্ঞ বলেও জানান।
মনোনয়ন প্রসঙ্গে আলাপকালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, দলের সভাপতি-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং নিশ্চয়ই অনেক খোঁজ-খবর নিয়েই সিটি মেয়র পদে মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছেন। মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দীর্ঘদিনের ত্যাগী, মার্জিত, শিক্ষিত ও অভিজ্ঞ নেতা এবং মাঠে সক্রিয় থাকেন। কোনো গ্রুপিংয়ের সাথে তার সম্পর্ক ছিলনা এবং নেই। তার মনোনয়ন যথার্থই। আমরা চট্টগ্রামবাসীর ঐক্যবদ্ধ সমর্থন নিয়ে নৌকা বিজয়ী করবো ইনশাআল্লাহ। সাইমুল চৌধুরী বলেন, রাজনীতিতে সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ণ পাওয়া যায় এবং কোনো গ্রুপিং তদবিরও করতে হয়না এ বিষয়টা রেজাউল করিমের মনোনয়নের মধ্যদিয়ে বিচক্ষণ নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আরেকবার প্রমাণ এবং সবার জন্য একটা মেসেজ দিয়ে দিলেন।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে নৌকার মাঝি ‘রেজাউল করিম সুপার চমকে’র বিষয়টি এখন পর্যন্ত টক অব দ্য চট্টগ্রাম। সবখানে নানামুখী আলোচনা। যার সুর ইতিবাচক। এ নিয়ে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আওয়ামী লীগের ভেতরে-বাইরে চলছে ব্যাপক তোলপাড়।
চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগে ‘মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রুপ’, ‘আ জ ম নাছির গ্রুপ’, ‘আবদুচ ছালাম গ্রুপ’, ‘নুরুল ইসলাম বিএসসি গ্রুপ’, ‘ডা. আফছারুল আমীন গ্রুপ’, ‘হাসিনা মহিউদ্দিন গ্রুপ’ ইত্যাদি নাম ও পরিচয়ে আন্তঃকোন্দল চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যার জেরে অনেকগুলো উপদল সক্রিয় ছাত্রলীগ ও যুবলীগেও। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে অশান্তি অস্থিরতা। অবৈধ অস্ত্রের দাপট। এমনকি এই গ্রুপিংয়ের ধাক্কা গিয়ে পড়েছে ব্যবসায়ী নেতাদের মাঝেও।
আসন্ন সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মেয়র পদে নৌকার মাঝি হওয়ার আশায় যে ১৯ জন দলীয় মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন তাদের বেশিরভাগই সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের একেকটি গ্রুপের নেতা অথবা প্রভাবশালী। সেই ১৯ জনের মধ্যে মহানগর আওয়ামী লীগে গ্রুপিংয়ের তকমা নিয়ে দীর্ঘদিন কমবেশি আলোচিতরা হলেন- বর্তমান মেয়র ও দলের মহানগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন, সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, সহ-সভাপতি সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও তার পুত্র মুজিবুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ সাবেক সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, ডা. আফছারুল আমীনের ভাই এরশাদুল আমীন।
সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালামের সঙ্গে অতীতে মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর দলীয় বিরোধ ছিল প্রবল। তবে এবার মেয়র পদে নৌকার মাঝি হতে মনোনয়নের জন্য ছালামের প্রতি মহিউদ্দিন পরিবারের সমর্থনের বিষয়টি ছিল আলোচিত। আবার বর্তমান মেয়র ও মহানগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনকে ঠেকানোর উদ্দেশে অধিকাংশ মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন কমবেশি একাট্টা। এ অবস্থায় নাছির এবার মেয়র পদের জন্য নৌকার মাঝি হতে পারবেন কিনা তা নিয়ে অনেকেই ছিলেন দোলাচলে।
মেয়র নাছির মনোনয়ন হারানোর পেছনে দলের ভেতরে গ্রুপিং ছাড়াও অন্যতম কারণ ছিল মহানগরীর পানিবদ্ধতা, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট সড়ক, যখন-তখন খোঁড়াখুড়ি, ধুলোবালির দূষণসহ ‘বার মাইস্যা দুঃখ’, ক্যাডারদের উৎপাত, আমলাদের সঙ্গে তার বিরোধের ঘটনা। চট্টগ্রাম মহানগরী এবং পাশ্ববর্তী ৫টি আসনেরই সরকার দলীয় এমপিদের সঙ্গেও রয়েছে তার দূরত্ব অথবা বিরোধ। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় দিকটি হচ্ছে, ছয় দফা মেয়াদকাল বাড়িয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান পদে আসীন থেকে অদৃশ্য শক্তিতে একের পর এক হাজার কোটি টাকার অঙ্কে বড়সড় উন্নয়ন বাজেট পেয়ে আসছিলেন আবদুচ ছালাম। অথচ বন্দরনগরী পানিবদ্ধতামুক্ত হলো না আজও। ওই সময়ে দৈনিক ইনকিলাবে সরেজমিনে সিরিজ নিউজ প্রকাশিত হয়- ‘টাকা পায় ছালাম- গালি খায় নাছির’ শিরোনামে। এসবের প্রেক্ষাপটে মহানগরীর সৌন্দর্যবর্ধন, পরিচ্ছন্নতা, সবুজায়ন, প্রতিদিনই প্রকল্পস্থলে গিয়ে কাজের অগ্রগতি সরেজমিনে পরিদর্শন, সমাজসেবামুখী কাজ, অন্যদিকে চট্টগ্রামে দলকে গোছানোসহ মেয়র এবং দলের মহানগর কান্ডারী হিসেবে নাছিরের অনেক ইতিবাচক সাফল্য, কর্মকান্ড কার্যত চাপা পড়ে গেছে।
সিটি মেয়র পদে শেখ হাসিনার চমক রেজাউল করিম চৌধুরীর দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসমূহে চলে আসা প্রকাশ্য কলহ-কোন্দল, গ্রুপিং হঠাৎ থমকে গেছে। গ্রুপিংয়ে পটু ছোট-বড় কোনো নেতাই এখন আর মুখ খুলতে নারাজ। সবাই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। অনেকের ধারণা, ৫৫ জন কাউন্সিলর পদে নৌকার মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম নগরে বিশেষত থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে গ্রুপিং মাথাচাড়া দিতে পারে।
রেজাউল করিমের অঙ্গীকার
সদ্য নৌকায় দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী গতকাল সাংবাদিকদের কাছে তার প্রাথমিক নির্বাচনী অঙ্গীকারে বলেছেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও নগরবাসীর সেবায় আমার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়োজিত করবো। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে আমার নেত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞ। চট্টগ্রামবাসীর দোয়া ও সমর্থন আমি আশা করি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছুই নেই। রাজনৈতিক জীবনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে, সততা, নিষ্ঠা, ত্যাগের পরীক্ষায় আমি অবিচল থেকেছি। এখন বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের জনগণের সেবায় জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাই।
চট্টগ্রাম মহানগরীর ব্যস্ত ও প্রাচীন এলাকা ৬নং পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের ঐতিহ্যবাহী ও বনেদী বহরর্দ্দার পরিবারে মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালের ৩১ মে। তিনি চান্দগাঁও স্কুল, চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর আইন বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তবে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকান্ডের পর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আইনে অধ্যয়ন সম্পন্ন করতে পারেননি।
১৯৬৭ সালে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগে যোগ দেন। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭০-১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭২-১৯৭৬ সালে সভাপতি, ১৯৭০ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা ছাত্রলীগ কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে দপ্তর সম্পাদক এবং ১৯৭৩-১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক, ১৯৭৬-১৯৭৮ সালে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, ১৯৭৮-১৯৭৯ সালে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক, ১৯৮০ সালে মহানগর যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য, ১৯৯২ মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য, ১৯৯৭-২০০৬ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক, ২০০৬-২০১৪ সালে মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ২০১৪ সাল থেকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাছাড়া তিনি মহানগরীসহ স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক, জনস্বার্থ ও জনকল্যাণমুখী কর্মকান্ডের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আত্মনিবেদিত।