ধর্ম না উন্নয়ন? এই প্রশ্নে দ্বিতীয় বিকল্পকেই বেছে নিল রাজধানী দিল্লি। তৃতীয়বারের জন্য দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে বসতে চলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। আসন কিছুটা কমলেও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসছে আম আদমি পার্টি (আপ)।
তবে বিজেপির আসন বাড়লেও ধর্মীয় মেরুকরণ, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি), জাতীয় জনসংখ্যা রেজিস্টারের (এনপিআর) ধাক্কায় এবারও দিল্লির মসনদ অধরাই থেকে গেল বিজেপির কাছে। কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল কংগ্রেস।
দেশটির আনন্দবাজার পত্রিকার খবরে বলা হয়, সকালে ইভিএম খোলা শুরু হতেই দিকে দিকে আপের জয়জয়কার। গণনায় ৭০টির মধ্যে ৬৩টি আসন পেয়ে দিল্লিতে ফের ক্ষমতায় আসতে চলেছে আপ। বিজেপি পেয়েছে ৭টি আসন। ভরাডুবির মধ্যে বিজেপির কাছে একমাত্র সান্ত্বনা, গত বারের চেয়ে আসন বাড়ানো।
কিন্তু কী এমন ম্যাজিক দেখিয়েছেন কেজরিওয়াল? প্রথমবার ৪৫ দিনের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কোজরিওয়াল কার্যত বোকামিই করেছিলেন বলে অনেকেই কটাক্ষ করেছিলেন। কিন্তু সেটা যে লম্বা দৌড়ের প্রস্তুতি ছিল, তা বোঝা গিয়েছে গত পাঁচ বছরে কেজরিওয়ালের উন্নয়নের রাজনীতিতে। গত পাঁচ বছরে সাধারণ মানুষের জন্য অনেক উন্নয়নমুখী প্রকল্প তৈরি এবং তার বাস্তব রূপায়ণের উপরেই আস্থা রেখেছেন দিল্লিবাসী।
উন্নয়ন প্রকল্পগুলি কেমন? এই ২০১৫ সালের নির্বাচনী ইস্তাহারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কেজরিওয়াল, সেগুলোর প্রায় সবকটি ধরে ধরে বাস্তবায়িত করে দেখানোর রাজনীতিতে কেজরিওয়ালের বিশ্বাসযোগ্যতা বেড়েছে। দিল্লিবাসীর জন্য ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মওকুফ করেছে আপ সরকার। নারীদের জন্য সরকারি বাসে বিনামূল্যে সফর এবং তাদের নিরাপত্তায় বাসে মার্শাল নিয়োগ করা, বিনা পয়সায় প্রতিদিন ৭০০ লিটার পর্যন্ত পানি দেওয়ার মতো প্রকল্প বাস্তবে করে দেখিয়েছে দিল্লির সরকার। নতুন অনেক স্কুল তৈরি হয়েছে, পুরনো স্কুলগুলোর খোলনলচে বদলে আধুনিক রূপ দেওয়া হয়েছে।
স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে কার্যত যুগান্তকারী বিপ্লব এনেছে কেজরিওয়ালের মহল্লা ক্লিনিক মডেল। এই ক্লিনিকগুলোতে বিনামূল্যে চিকিৎসা তো বটেই ওষুধও দেয় সরকার। এই মহল্লা ক্লিনিকগুলো পরিদর্শন করেছে ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ‘হু’-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা। এই সব সংস্থাও এই ক্লিনিকগুলোর দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন।
এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য এই জনমুখী প্রকল্প হলেও এটাই ছিল কেজরিওয়ালের সুকৌশলী রাজনৈতিক ইউএসপি। ভোটেপ্রচারেও এই উন্নয়ন মডেলকেই হাতিয়ার করেছিলেন কেজরিওয়াল। বিজেপির ধর্মীয় মেরুকরণের উস্কানিতে পা না দিয়ে প্রচার করে গিয়েছেন শুধু নিজের সরকারের এই সব জনমুখী প্রকল্পের সাফল্য। শাহিন বাগের আঁচ কার্যত গায়ে মাখেননি, জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলার ঘটনায় কার্যত মুখ খোলেননি। দিল্লিবাসীকে বোঝাতে পেরেছেন, জাত-পাত, ধর্মীয় বিভেদ নয়, উন্নয়নই তার পাখির চোখ।
অথচ কয়েক মাস আগের লোকসভা ভোটেও ভরাডুবি হয়েছিল আপের। সাতটির একটিতেও জিততে পারেনি আপ। সব কটি আসন ঝুলিতে পুরেছিল বিজেপি। তার উপর নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের মতো ধুরন্ধর রাজনৈতিক জুটির বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে কেজরিওয়ালকে। এই দু’জন তো বটেই দলের সব সংসদ সদস্য, একাধিক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের এনে প্রচার করেছে বিজেপি। ধর্মীয় মেরুকরণের তিরে বিঁধলেও তার বিরুদ্ধে কেজরিওয়াল সে সব গায়ে মাখেননি। সিএএ-এনআরসি নিয়ে কোনও জনসভায় একটি কথাও শোনা যায়নি তার মুখে।
তার সঙ্গে বিরোধী ভোটকে একমুখী করার কৃতিত্বও কেজরিওয়ালের প্রাপ্য। ভোটের ফলের দিকে নজর রাখলেই দেখা যাবে ভোট হয়েছে কার্যত দ্বিমুখী। এক দিকে বিজেপি। বিপরীতে আপ এবং অবিজেপি। কংগ্রেসের নেতা কর্মীদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন, নিজের দল ছাড়তে হবে না, শুধু এ বারের জন্য আপকে ভোট দিন। সেই আর্জিতেও কাজ হয়েছে। বিজেপি বিরোধী ভোটের প্রায় পুরোটাই পকেটে পুরতে পেরেছেন কেজরিওয়াল।
পর পর দু’বার ৫০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসার নজিরও খুব কম দলেরই রয়েছে। ২০১৫ সালে আপ পেয়েছিল ৫৪.৩ শতাংশ ভোট। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩২.২ শতাংশ ভোট। এবার আপের আসন কিছু কমলেও ভোটপ্রাপ্তির নিরিখে খুব বেশি হেরফের হয়নি।
কিন্তু কেজরিওয়ালের যাত্রা এতটা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। এমনকী, ঘনিষ্ঠ মহলে কেজরিওয়াল স্বীকার করেছেন, সরাসরি রাজনীতিতে আসার কথা কেরিয়ারের শুরুতে কখনওই ভাবেননি। কিন্তু ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিসের নিশ্চিন্ত সরকারি চাকরি ছাড়ার পর থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যে ভাবে ঘটনা প্রবাহ এগিয়েছে, তাতে ধীরে ধীরে রাজনীতির গণ্ডিতে কার্যত নিজের অজান্তেই পা দিয়ে ফেলেছিলেন খড়গপুর আইআইটির প্রাক্তনী কেজরিওয়াল।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, কেজরিওয়ালের অজান্তেই সেই পথের সূচনা হয়েছিল সমাজকর্মী অন্না হজারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে টানা অনশন-ধর্না আন্দোলন। লোকপাল বিলের দাবিতে যে ভাবে দিনের পর দিন অনশন ও শান্তিপূর্ণ অবস্থান আন্দোলন করেছিলেন কেজরিওয়াল, তাতে তার মধ্যে এক নতুন নেতার স্ফুলিঙ্গ দেখেছিলেন দেশবাসী। সেই মাফলার ম্যন কেজরিওয়ালের হাত ধরেই দেশবাসী স্বপ্ন দেখেছিলেন এক নতুন ভারতের। এক দুর্নীতিমুক্ত ভারতের।