জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. ফারজানা ইসলামের পদত্যাগ দাবিতে চলমান আন্দোলন প্রশ্নে হার্ডলাইনে সরকার। গতকাল এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে কঠোর ভাষায় বলেছেন, দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ তাদের হাতে থাকার কথা। অভিযোগ করলে চলবে না। প্রমাণ দিতে না পারলে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় হল বন্ধ করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। হলে কেউ থাকতে পারছে না। ক্যান্টিন, ডাইনিংসহ ক্যাম্পাসের সব খাবার দোকান বন্ধ করে দেওয়া হলেও বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী হল ছেড়ে চলে গেলেও আন্দোলন থামেনি। গতকালও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মিছিলে স্লোগানে ক্যাম্পাস ছিল উত্তাল। আন্দোলনরত শিক্ষকরাও সংহতি সমাবেশের ব্যানারে অবস্থান নেন ভিসির বাসভবনের সামনে।
উপাচার্যের বাসভবনের সামনে দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিচ্ছে পুলিশ। সভা-সমাবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এত দুর্ভোগ আর নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে এখনো আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’। হল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার ঘোষণার দ্বিতীয় দিনেও গতকাল উপাচার্যের অপসারণ, আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং হল ছাড়ার নির্দেশের প্রতিবাদে দিনভর বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
খাবারের জন্য আন্দোলনকারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী সাভার, নবীনগর এবং বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন গেরুয়া, আমবাগান ও ইসলামনগরের হোটেলগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। খাবার পাওয়া গেলেও পরিমাণে তা যথেষ্ট নয়। তাই অধিকাংশ সময় না খেয়েই কাটাতে হচ্ছে তাদের। আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বাসায় রাত কাটানোর সুযোগ থাকলেও সেখানে জায়গা হচ্ছে না সবার। ফলে রাতের বেলা থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন গেরুয়া, আমবাগান ও ইসলামনগরের স্থানীয় ও ভাড়াটে বাসিন্দাদের বাসায় ধরনা দিতে হচ্ছে। নানা প্রশাসনিক বাধা, দুর্ভোগের মধ্যেও আন্দোলনে অবিচল শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। তাদের সংগঠন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে গতকাল দুপুর ১টায় শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে একটি বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা। মিছিল শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে থেকে। এরপর চৌরঙ্গি মোড় ও জয় বাংলা গেটের রাস্তা হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে উপস্থিত হন বিক্ষোভকারীরা। বিক্ষোভ মিছিল উপাচার্যের বাসভবনের সামনে এলে বাসভবনে প্রবেশের গেটে সতর্ক অবস্থানে দাঁড়িয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। এ অবস্থায় আন্দোলনকারী কিছু শিক্ষক পুলিশ ও বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মাঝখানে ব্যারিকেড তৈরি করে। ২০ মিনিট সেখানে অবস্থান করার পর আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আবার পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে ফিরে যান। সেখানে আন্দোলনের সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে বিবৃতি দেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরপর সন্ধ্যায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে হয় প্রতিবাদী কনসার্ট।
এদিকে গতকাল দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশে আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মাহাথির মুহাম্মদ বলেন, ‘টাকার ভাগ পাওয়া ছাত্রলীগ নেতারা যেখানে নিজেই টাকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন সেখানে আর কত প্রমাণ দরকার? তদন্তের মুখোমুখি না হয়ে উপাচার্য নিজেই নিজেকে দুর্নীতিবাজ প্রমাণ করেছেন। এদিকে আন্দোলন দমাতে আন্দোলনকারীদের ওপর “শিবির” ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। তাদের ওপর ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিচ্ছেন দুর্নীতিবাজ উপাচার্য। দুর্নীতিমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার যে পবিত্র আন্দোলন আমরা শুরু করেছি তাকে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে যারা নস্যাৎ করার চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধেও দুর্গ গড়ে তোলা হবে। উপাচার্য ফারজানা ইসলাম জাবির পরিবেশ দূষিত করে ফেলেছেন। তাকে অপসারণ না করা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় তার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে পাবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে উপাচার্য তদন্তের মুখোমুখি না হয়ে ছাত্রলীগকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর লেলিয়ে দিতে পারেন, সম্মানিত শিক্ষকদের ওপর হাত তোলার নির্দেশ দিতে পারেন উপাচার্য নামক সম্মানজনক পদে থাকার অধিকার সেই ব্যক্তির থাকে না। জাবি ও জাবির মানমর্যাদা রক্ষায় ব্যক্তি ফারজানার অপসারণের বিকল্প নেই।’ গত বছরের ২৩ অক্টোবর একনেকে জাবির অধিকতর উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়। প্রকল্পের শুরু থেকেই অপরিকল্পিত উন্নয়ন পরিকল্পনা, সহস্রাধিক গাছ কাটা এবং শাখা ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে টেন্ডার ছিনতাইয়ের অভিযোগে সমালোচনার মুখে পড়ে বিশাল এই প্রকল্প। এরপর এ বছর ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘উন্নয়ন প্রকল্পের ২ কোটি টাকা ছাত্রলীগের পকেটে’ শীর্ষক সংবাদ প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ঈদুল আজহার সালামি হিসেবে শাখা ছাত্রলীগকে এ টাকা দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর পর থেকেই উপাচার্যকে দুর্নীতিবাজ আখ্যা দিয়ে তার অপসারণ দাবিতে আন্দোলন শুরু করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’। তিন মাসের লাগাতার আন্দোলনের পর গত সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে সংগঠনটির ব্যানারে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবন ঘেরাও করেন। পরদিন ৫ নভেম্বর শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালান। এতে আট শিক্ষকসহ অন্তত ৩৫ জন আহত হন। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে সেদিনই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
জাবি ছাত্রলীগ সম্পাদকের পদত্যাগ : জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবু সুফিয়ান চঞ্চল পদত্যাগ করেছেন। গত মঙ্গলবার ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদকের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিলেও গতকাল সন্ধ্যায় এটি জানাজানি হয়। দফতর সম্পাদক আহসান হাবিব পদত্যাগপত্র পাওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন তবে পদত্যাগের কারণ জানাননি। আহসান হাবিব সাংবাদিকদের বলেন, ‘মঙ্গলবার পদত্যাগপত্র পেয়েছি। আমি পড়ে দেখিনি। সভাপতি-সেক্রেটারির কাছে হস্তান্তর করেছি। ধারণা করছি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে হতে পারে। পদত্যাগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হলে প্রেস রিলিজ দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।’
কর্মসূচি : উপাচার্যের অপসারণ দাবিতে আন্দোলনরতদের মুখপাত্র অধ্যাপক রায়হান রাইন আজকের কর্মসূচি সম্পর্কে বলেন, ‘বেলা ১১টায় পুরাতন প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান ও প্রতিবাদী পটচিত্র অঙ্কন এবং পুরো ক্যাম্পাসে প্রদর্শনী কর্মসূচি পালন করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তথ্য-প্রমাণ জমা দেওয়া হবে। আমাদের কাছে যে প্রমাণগুলো আছে তাতে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম আর কোনোভাবেই তার পদে থাকতে পারেন না।’