বাংলাদেশে বিরোধীদল বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির প্রশ্নে সরকার ইতিবাচক সাড়া না দিলেও দলটির এমপিদের সমঝোতার সেই উদ্যোগ বা চেষ্টা অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে।
তবে খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির ব্যাপারে সরকারের আনুকূল্য পাওয়ার জন্য তাঁর দলের এমপিদের চেষ্টা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে বলা যায়।
বিএনপির একাধিক এমপির সাথে কথা বলে মনে হয়েছে, প্যারোলে নাকি জামিনে মুক্তি — এই প্রশ্নের মুখে পড়েছিল তাদের সেই চেষ্টা।
তারা সরকারের আগ্রহ দেখেছেন প্যারোলে মুক্তির ব্যাপারে। কারণ তাতে শর্ত জুড়ে দেওয়া যায় এবং সরকারের আনুকূল্য দেখানোর বিষয় সরাসরি দৃশ্যমান হয়।
কিন্তু প্যারোলে মুক্তি হলে সেটা খালেদা জিয়া এবং বিএনপির জন্য রাজনৈতিক মৃত্যু হবে বলে দলটির নেতারা মনে করেন।
তারা চাইছেন, জামিনে মুক্তির ক্ষেত্রে সরকারের নমনীয় অবস্থান।
এই সমঝোতার চেষ্টা যারা করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশিদ। তার দলের নেত্রীর মুক্তির বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাথে দেখা করে আলোচনা করেছিলেন।
হারুনুর রশিদ বিবিসিকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে আমিই ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছি, উনার (খালেদা জিয়া) জামিনে মুক্তির জন্যে। তো উনারা বারবার বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারা আদালতের কথা বলেন যে এটা আদালতের এখতিয়ার এবং তাদের কিছু করার নেই।
“আসলে আমাদের দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বয়স এখন ৭৬। উনি সাংঘাতিকভাবে অসুস্থ। উনার উন্নত চিকিৎসা দরকার। সেটা দেশের ভেতরে হোক আর দেশের বাইরে হোক। সেজন্য আমাদের এই উদ্যোগটা অব্যাহত থাকবে।”বিএনপির এমপিদের এই উদ্যোগ নিয়ে দলটির ভিতরে অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়।
তবে দলটির সব পর্যায়ের নেতা কর্মীরাই মনে করেন যে, এখন সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নমনীয় অবস্থান ছাড়া খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তি সম্ভব নয়। কারণ বিএনপি তাদের নেত্রীর মুক্তির ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক দিক থেকে চাপ সৃষ্টির তাদের চেষ্টাতেও কোন ফল হয়নি।
অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ এবং চ্যারিটেবল ট্রাস্টে দুর্নীতি যে দু’টি মামলায় খালেদা জিয়ার ১৭ বছরের সাজা হয়েছে, সেই দু’টিতেই হাইকোর্টে তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ হয়েছে।
এখন তারা জামিনের আবেদন নিয়ে আপিল বিভাগে যাবেন। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের পর আর কোথাও যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
সেখানে সরকারি আইনজীবী যাতে নমনীয় অবস্থানে থাকেন, সরকারের কাছ থেকে সেই সহযোগিতা চাইছে বিএনপি।
সেজন্য সরকারের সাথে সমঝোতা প্রয়োজন বলে দলটির অনেকে মনে করেন। সেখানে রাজনৈতিকভাবে কোন পরাজয় যাতে না হয়, সেটাও দলটির নেতৃত্ব বিবেচনা করছে।
শেষ পর্যন্ত বিএনপি নেতারা দেখাতে চান যে, খালেদা জিয়া আইনগত প্রক্রিয়ায় জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।
দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ড: খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলছেন, তারা আইনগত প্রক্রিয়াতেই তাদের নেত্রীর মুক্তি চান।
“মানবিক দিক এবং তাঁর অসুস্থতার জন্য জামিনে মুক্তি দিয়ে আমরা তাঁর উন্নত চিকিৎসার দাবি জানিয়ে আসছি। আমরা আন্দোলন করছি, সমাবেশ করছি, মানববন্ধন করছি।”
“অতএব আমাদের দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আমরা নেত্রীর উন্নত চিকিৎসার জন্য জামিনে মুক্তি চাই। তিনি যেখানে মনে করবেন, সেখানে চিকিৎসা করাবেন। তবে তার আগে তাঁর মুক্তি প্রয়োজন।”
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে স্কাইপের মাধ্যমে আলোচনা করে নীতি-নির্ধারকরা বিভিন্ন সময় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
খালেদা জিয়ার কোথায় চিকিৎসা করাবেন – কোন শর্ত হয়েছে?
মুক্তি পেলে খালেদা জিয়া বিদেশে যাবেন নাকি দেশেই থাকবেন – এই প্রশ্নও আলোচনায় এসেছে বলে জানা গেছে।
তাঁর দলের এমপিরাও বলেছেন, তিনি মুক্তি পেলে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন।
তাঁর একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, ডায়াবেটিস, আর্থরাইটিস সহ বিভিন্ন রোগে এখন বয়সের কারণে খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ হয়েছে এবং এই অবস্থায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশেই নিতে হতে পারে।
বিএনপি নেতাদের অনেকে বলেছেন, তাদের দল এখন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা করানো বা তাঁকে সুস্থ রাখার বিষয়কেই এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে।
খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর পরই তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়েছে। কিন্তু মি: রহমানও মামলা-মোকদ্দমার কারণে এখনও বিদেশে নির্বাসনে রয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নীতি-নির্ধারণী ফোরামের সদস্যদের সাথে আলোচনা করে এবং তারেক রহমানের পরামর্শ নিয়ে বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক কৌশল ঠিক করছেন।
কিন্তু বিএনপির অনেক নেতা বলছেন, যৌথ পরিচালনার কারণে দলের কার্যক্রম চালাতে সমস্যা হচ্ছে। তারা মনে করেন, এ কারণে দীর্ঘ সময়েও সরকারের বিরুদ্ধে শক্ত কোন অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি।
তারা বলেছেন, খালেদা জিয়াই তাদের দলের ঐক্যের প্রতীক। ফলে তিনি মুক্তি পেয়ে দেশে বা বাইরে যেখানেই থাকুন না কেন, তাদের দলের নেতা-কর্মীরা সাহস পাবেন। তাদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং তা বাস্তবায়নের তাগিদও সৃষ্টি হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলেছেন, সরকার সাড়া দিক বা না দিক—দু’টোই বিএনপির জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে ইতিবাচক হবে।
“মানবিক কারণে বিএনপি সরকারের সহযোগিতা চাইছে। সরকার সাড়া না দিলে বিএনপি সে বিষয়টি মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারবে। একইসাথে এই ইস্যুতে দলের নেতা-কর্মীরাও উজ্জীবিত হতে পারে।”
তবে অনেক বিশ্লেষক এটাও বলছেন যে, বিএনপি যেহেতু সরকারের ওপর কোন দিক থেকেই চাপ সৃষ্টি করতে পারে নি, ফলে সরকারও খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে কোন তাগিদ অনুভব করছে না।
২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছিল বিএনপি
সরকার সাড়া না দিলে বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন যে, সরকার যেহেতু বেকায়দায় পড়েনি, সেকারণে খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির ব্যাপারে কোন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে না।
সেজন্য বিএনপি নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মাঠে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
সরকার-বিরোধী সব শক্তিকে এক জায়গায় আনার চেষ্টাও তাদের মধ্য রয়েছে।
কিন্তু এতে অনেক সময় প্রয়োজন। আর সেজন্যই এখন জরুরি কৌশল হিসেবে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার মতো মানবিক বিষয়কে তুলে ধরে জামিনে মুক্তির জন্য এগুতে চাইছে বিএনপি।