প্রতিদিন বাড়ছে আসামির সংখ্যা। মামলা দায়ের ও অভিযানে ব্যস্ত পুলিশ। চলছে গণগ্রেপ্তার। গ্রেপ্তার হচ্ছে বিরোধীদলীয় শ’ শ’ নেতাকর্মী। দেশের প্রতিটি কারাগারে এখন ‘ঠাঁই নেই’ অবস্থা। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সারা দেশে ২০ দিন অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে ১৮ দল। ২৫শে নভেম্বর দশম জাতীয় নির্বাচনের একতরফা তফসিল ঘোষণার পর শুরু হয় এ অবরোধ। ৫ দফায় তিন ও পাঁচদিনের টানা এ কর্মসূচি পালন করেছে বিরোধী জোট। ২০ দিনের অবরোধে নানা সহিংসতার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় আসামি করা হয়েছে বিরোধীদলের অন্তত ৭০ হাজার নেতাকর্মীকে। একেকটি মামলায় আসামি করা হচ্ছে ৫০ থেকে ২০০০ নেতাকর্মীকে। বিরোধী দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল প্রত্যেক নেতার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে ২ থেকে শতাধিক পর্যন্ত মামলা। কেউ কেউ রাজপথের পাশাপাশি ছুটছেন আদালতে। বেশির ভাগই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে থেকেই চালাচ্ছেন অবরোধ কর্মসূচি। গ্রেপ্তার করা হয়েছে অন্তত ১২ হাজার নেতাকর্মীকে। যাদের মধ্যে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি বিএনপি ও অঙ্গদলের নেতাকর্মী। বাকিরা শরিক দল জামায়াতের নেতাকর্মী। ঘরছাড়া হয়েছেন অন্তত ৩০ জেলা বিএনপি ও জোটের নেতারা। এদিকে বিরোধী জোটের অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জমজমাট পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য। নির্বিচারে আটক করা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। সরকার মামলার জালে আটকে ফেলেছে বিরোধী দলের রাজনীতি। অব্যাহত গুম, খুন ও গণগ্রেপ্তারে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে সারা দেশে। দেশের এই পরিস্থিতি নিয়ে সমপ্রতি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংবাদপত্র গার্ডিয়ান প্রকাশ করেছে ‘বাংলাদেশ নামের জেলখানা’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন। দ্বিতীয় দফা অবরোধ কর্মসূচির ঘোষণার পর রাতেই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে দলের দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি পুলিশ। দ্বিতীয় দফা অবরোধকে কেন্দ্র সংঘটিত সহিংস ঘটনায় রাজধানীতে হত্যা মামলাসহ একাধিক মামলায় সন্দেহভাজন আসামি করা হয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবদুস সালামসহ বিএনপি ও জোটের অন্তত অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে। একে একে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) আসম হান্নান শাহ, ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মীর মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আকবর খন্দকার, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর শরফত আলী সপু, সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল বারী বাবু, ছাত্রদল সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রশীদ হাবিব, সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ, ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ারসহ বিএনপি ও অঙ্গদলের অন্তত ২০ সিনিয়র নেতাকে। এর আগে গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এমকে আনোয়ার, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাসকে। এছাড়াও ২০ দিনের অবরোধে রাজধানীতে লালবাগ থানা স্বেচ্ছাসেবক দল সম্পাদক সফিউদ্দিন আহম্মেদ, লালবাগ যুবদলের সভাপতি তাসাদ্দেক হোসেন বাবুল, ছাত্রদলের মহানগর দক্ষিণ যুগ্ম সম্পাদক বাবু, আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দল সম্পাদক ফারুক, আদাবর থানা বিএনপির সভাপতি আবুল হাসেম, ধানমন্ডি থানা বিএনপি’র সদস্য সচিব শেখ রবিউল আলম, জামালপুর শহর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইদ চৌধুরী মিঠু, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা যুবদল সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস, মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলা যুবদল সভাপতি ও পৌর কাউন্সিলর জামাল হোসেন, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা বিএনপি সভাপতি রফিকুল ইসলাম লাবু, ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ পৌর কাউন্সিল আনোয়ার হোসেন, মুন্সিগঞ্জে জেলা যুবদলের সম্পাদক সম্রাট ইকবাল, নারায়ণগঞ্জে যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক ডা. মনির হোসেন, সিরাজগঞ্জ জেলা যুবদল নেতা আবু সাইদ সুইট, সদর সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান, গাইবান্ধার সাঘাটা থানা যুবদল সভাপতি আহম্মেদ কবির শাহিন, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, যুবদল নেতা কাউন্সিলর জাকির হোসেন, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর পৌর যুবদল সভাপতি আবদুল মালেক, মেহেরপুরের গাংনী পৌর যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক আসাদুল ইসলাম, নরসিংদী জেলা ছাত্রদল যুগ্ম সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান নাহিদ, শ্রমিক দল জেলা যুগ্ম সম্পাদক আলক মিয়া, বরগুনা জেলা ছাত্রদল যুগ্ম সম্পাদক আহসান হাবিব স্বপন, নারায়ণগঞ্জ থানা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক সালাউদ্দিন, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা যুবদল সভাপতি ফজলুল কাদের ও ছাত্রদল সম্পাদক গাজী মনির, কুমিল্লার চান্দিনা পৌরসভার চেয়ারম্যান শাহ আলমগীর হোসেন, ফরিদপুর জেলা বিএনপির স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক সদরপুর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি আবদুল্লাহ সরদার বাবুসহ বিএনপি, অঙ্গদল ও জামায়াতের কয়েকশ জেলা ও উপজেলা নেতা এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় বিরোধীদল সমর্থক অন্তত ৩০জন ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। অবরোধে সহিংসতায় বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত হয়েছে লক্ষ্মীপুর, বগুড়া, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, নীলফামারী, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নাটোর, যশোর, জয়পুরহাট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, গাইবান্ধা, খুলনা, দিনাজপুর, রাজশাহী, লালমনিরহাট, ফেনী, ঠাকুরগাঁও, কুষ্টিয়াসহ অন্তত ৩০ জেলা। এক সপ্তাহ ধরে দেশে অন্তত ২০ জেলায় চলছে পুলিশ-র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে যৌথবাহিনীর অভিযান। একদিকে চলছে যৌথবাহিনীর ধরপাকড়, অন্যদিকে বিরোধী নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ। ওদিকে ২৬শে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহে নিখোঁজ হয়েছেন সাবেক এমপি, সাংবাদিক, বিএনপি ও ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাসহ অন্তত অর্ধশত। ২০দিনের অবরোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলি ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলা যুবদল সম্পাদক আবদুল গফুর, নাটোরে যুবদল নেতা সাইদুজ্জামান সুজন, ফেনী যুবদল নেতা হারুণ-অর রশিদ, কুমিল্লা স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা আবু বেপারী, কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক মুন্সী রশিদুর রহমান, যশোরে জেলা ছাত্রদল সহ-সভাপতি, লক্ষ্মীপুরে বিএনপি নেতা মাহবুব হোসেন, যুবদল নেতা ইকবাল মাহমুদ জুয়েল, পিরোজপুরে বিএনপি নেতা শুক্কুর আলী হাওলাদার, কুষ্টিয়ায় জেলা বিএনপির নেতা ও জগন্নাথপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান মুন্সি রশিদুর রহমানসহ অন্তত ৮০জন নেতাকর্মী। অবরোধ কর্মসূচি পালন ও অভিযানের সময় গুলিবিদ্ধ এবং আহত হয়েছেন রাজশাহী সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, খুলনা সিটি মেয়র মনিরুজ্জামান, গাজীপুর সিটি মেয়র প্রফেসর আবদুল মান্নান, সিরাজগঞ্জে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির সম্পাদক সাহাবউদ্দিন সাবু, বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য সম্পাদক ও ঢাকা মহানগর যুগ্ম আহবায়ক আবু সাঈদ খান খোকন, নরসিংদী জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি সুলতান উদ্দিন মোল্লা, সুনামগঞ্জে জেলা বিএনপির সম্পাদক ও সাবেক এমপি কলিম উদ্দিন মিলন, জেলা ছাত্রদলের সম্পাদক ফয়জুর রহমান পাভেল, নাটোর জেলা যুবদল সাংগঠনিক সম্পাদক ডালিমসহ হাজার হাজার নেতাকর্মী কাতরাচ্ছেন হাসপাতালে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দাবি করেছে, অবরোধ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৬৫৯৪ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও ৫১৪৭২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। বিএনপির হিসাব অনুযায়ী ২৬-২৮শে নভেম্বর গ্রেপ্তার ১২০০, আসামী ১৬০০০, আহত ৩২০০, ৩০শে নভেম্বর গ্রেপ্তার ২৬৮ জন, ১লা ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ২৫০, আসামী ২২০০, আহত ৭০০, ২রা ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ২৫১, আসামী ২৫০০, আহত ৫৮৭, ৩রা ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৯৭, আসামী ৩০০০, আহত ১২১৭, ৪ঠা ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ২৬৭, আসামী ২৭০০, আহত ৭৫০, ৫ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৯৩, আসামী ২১০০, আহত ৪৭৯, ৭ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩২৬, আসামী ১২০০, আহত ৩২০, ৮ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৮০, আসামী ২৫০০, আহত ৬৯৭, ৯ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩১৯, আসামী ২৭০০, আহত ১০৫০, ১০ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ২৯৯, আসামী ২৩০০, আহত ১০৫০, ১১ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৭০, আসামী ১৫০০, আহত ৭৮৫, ১৭ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ১৭১, আসামী ৪০০০, আহত ২৫১, ১৮ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৭৩, আসামী ২৭০০, আহত ৪৮৭, ১৯শে ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৫৩৩, আসামী ৩০০০, আহত ৭২২, ২১শে ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৮৫, আসামী ৫০, আহত ৫২৩, ২২শে ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৩৭, আসামী ২৬০০, আহত ৪৮৮, ২৩শে ডিসেম্বর গ্রেপ্তার ৩৭৫, আসামী ২৭০০ ও আহত ৫২৭। অবরোধে সংঘর্ষ, হামলা ও অভিযানের সময় আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর গুলি ও সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের হামলায় আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ হাজার। বিরোধী নেতাদের ৬ বছরের সন্তান থেকে ১৫ বছরের মেয়ে পর্যন্ত ভ্রাম্যমান আদালতের সাজা ভোগ করছেন অন্তত দেড় শতাধিক। জামায়াত সূত্র জানায়, সার্বিক প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রেপ্তার ও আসামীর সঠিক পরিসংখ্যান তাদের কাছে নেই। তবে সারা দেশে গ্রেপ্তারকৃত নেতাকর্মীর সংখ্যা ৫ হাজার ও আসামী সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক হবে।
উৎসঃ মানবজমিন