নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন ১৪ দলের মুখপাত্র স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। সাংবিধানিক পদে থেকে নির্বাচন কমিশনের গোপনীয় বিষয় প্রকাশ্যে কথা বলায় তিনি খুব অন্যায় করেছেন বলে মন্তব্য করেন নাসিম।
বুধবার রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ১৪ দলের সভা শেষে ব্রিফিংয়ে এমন মন্তব্য করেন মোহাম্মদ নাসিম।
মাহবুব তালুকদার প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য নাসিম বলেন, ‘এটা তিনি খুব অন্যায় করছেন। শপথ নিয়ে সাংবিধানিক পদ নিয়ে এ ধরনের কথা প্রকাশ্যে তিনি বলছেন কেন? যদি আলোচনায় কিছু হয়েও থাকে, আলোচনা হতেই পারে। তার মানে এই নয় প্রকাশ্যে আপনি এসে বলবেন। অন্যায় করছেন, অযৌক্তিক কাজ করছেন। এ ধরনের পদে থেকে এ ধরনের আচরণ তার করা উচিত না। অন্যথা তাঁর পদটা ছেড়ে দেওয়া উচিত।’
পাশাপাশি সেনাপ্রধানকে নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মন্তব্যের সমালোচনা করে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এক প্রশ্নের জবাবে জোট মুখপাত্র বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাজোট হয়েছিল, এখন আর মহাজোট নেই।’
১৪ দলের আকার বাড়া-কমার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নির্বাচনী জোট কেমন হবে সেই সিদ্ধান্ত নিবেন ১৪ দল নেতা শেখ হাসিনা।’
সভায় সিদ্ধান্ত হয় আগামী ২৫ অক্টোবর রাজধানীর মতিঝিলে এবং ২৬ অক্টোবর চুয়াডাঙ্গায় সমাবেশ করবে ১৪ দল।
এর আগে গত সোমবার ১৫ অক্টোবর নোট অব ডিসেন্ট (আপত্তি) দিয়ে নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেন মাহবুব তালুকদার। তিনি জানিয়েছিলেন, সেদিনকার সভায় তার কিছু প্রস্তাবনা রাখার কথা থাকলেও, তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। তাই, প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি সভা বর্জন করেন।
সোমবার বেলা ১১টা ৭ মিনিটে নির্বাচন কমিশন ভবনে কমিশনের ৩৬তম সভা চলাকালে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে মাহবুব তালুকদার সভা বর্জন করেন। পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদার সভাপতিত্বে অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাংবাদিকদের নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার কারণ জানান মাহবুব তালুকদার।
মাহবুব তালুকদারের নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার বিষয় ছিল : নির্বাচন কমিশন সভায় বক্তব্য রাখতে না দেওয়ায় নোট অব ডিসেন্ট। প্রাপক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল প্রধান নির্বাচন কমিশনার। তার সেই নোট অব ডিসেন্ট নিচে তুলে ধরা হলো
১. বিগত ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮ তারিখে আমি একাদশ জাতীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে কতিপয় প্রস্তাবনা শিরোনামে আমার বক্তব্য নির্বাচন কমিশন সভায় উপস্থাপন করার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশন বরাবর একটি ইউ নোট পাঠাই। পরে এর একটি সংশোধনীও আমাকে পাঠানো হয়। ৮ অক্টোবর সচিবালয় থেকে আমার প্রস্তাবনাগুলো ১৫ অক্টোবরের নির্বাচন কমিশনের ৩৬তম সভায় উত্থাপন করতে বলা হয়।
২. উল্লেখ্য, গত ৩১ জুলাই ২০১৭ থেকে ২৪ অক্টোবর ২০১৭ পর্যন্ত প্রায় তিন মাসব্যাপী নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। এতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অংশীজন ছাড়াও ৪০টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে। সবার সংলাপ একত্রিত করে তা প্রস্তাব আকারে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ওই সব সংলাপের বিষয়ে আজ পর্যন্ত কমিশন সভায় কোনো আলোচনা না হওয়ায় কোনো সংলাপের কোনো কার্যকারিতা পরিলক্ষিত হয় না। ফলে ব্যক্তিগতভাবে আমি একটি পর্যালোচনা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। এবং অংশীজনের সংলাপের আলোকে আমার প্রস্তাবনাসমূহ লিপিবদ্ধ করে কমিশন সভায় পেশ করতে নির্বাচন কমিশনের কার্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানাই।
৩. আমার প্রস্তাবনাগুলো যাতে কমিশন সভায় উপস্থাপন করতে না দেওয়া হয়, সেজন্য তিনজন নির্বাচন কমিশনার এক ও অভিন্ন চিঠি লিখে পৃথক পৃথক ইউ নোটের মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে অনুরোধ জানান। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও তাদের সঙ্গে একমত হওয়ায় আমাকে প্রস্তাবনাগুলো উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশন সভায় আমার বক্তব্য উপস্থাপন করতে না দেওয়ায় তাদের অভিন্ন অবস্থান আমাকে বিস্মিত ও মর্মাহত করেছে।
৪. বাক প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান প্রদত্ত আমার মৌলিক অধিকার। নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই আমার এই অধিকার খর্ব করতে পারে না। এমতাবস্থায় অন্য উপায় না পেয়ে আমি নির্বাচন কমিশনের এরূপ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নোট অব ডিসেন্ট প্রদান করছি এবং প্রতিবাদ স্বরূপ নির্বাচন কমিশন সভা বর্জন করছি।
এসব কথা লিখে নোট অব ডিসেন্টে স্বাক্ষর করেন মাহবুব তালুকদার।
মাহবুব তালুকদার ৩৬তম কমিশন সভায় যেসব প্রস্তাব রাখতে চেয়েছিলেন সেগুলো পরে লিখিত আকারে সাংবাদিকদের জানান। লিখিত বক্তব্যের শুরুতে তিনি নোট অব ডিসেন্টে দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরেন। এরপর পাঁচটি বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরেন। সেগুলো নিচে দেওয়া হলো :
ক. জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েন : আগের নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনীর কার্যক্রম মূল্যায়ন করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কীভাবে তাদের ব্যবহার করা যায়, তা ঠিক করতে হবে।
খ. অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন : অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে নির্বাচনে অনিয়মের পথ বন্ধ হয়। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না হলে তা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশকে সমর্থন করে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলোচনা করতে পারে।
গ. নির্বাচনে নিরপেক্ষতা : নির্বাচনের নিরপেক্ষতা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ওপর নির্ভর করে। নির্বাচনকালে সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় রাখা নির্বাচন কমিশনের একার ওপর নির্ভর করে না। এতে সরকারের সহযোগিতা দরকার।
ঘ. নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি : নির্বাচন কমিশনের যথেষ্ট ক্ষমতা আছে। কিন্তু ক্ষমতা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতাও আছে। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বাস্তবতায় কমিশন ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ওপর খুব একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে না। ক্ষমতা প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে কীভাবে আরো নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায়, তা দেখা উচিত।
ঙ. সরকারের সঙ্গে সংলাপ : জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার নির্বাচন কমিশনের বড় অংশীজন। সংলাপে দেখা যায়, কিছু বিষয় রাজনৈতিক বা সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। এসব বিষয়ে সরকারের সঙ্গে সংলাপ আবশ্যক।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২ সংশোধন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের মুলতবি সভা চলাকালে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নিয়ে নিজের আপত্তির কথা জানিয়ে বৈঠক বর্জন করেছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।