চেষ্টা কম হচ্ছে না। নাটকের পর নাটক দেখাচ্ছেন তিনি। মহাজোটের শরীক হয়েও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আওয়ামী লীগকে কম দুশ্চিন্তায় ফেলেননি। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং’এর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে মহাজোটের অন্যান্য অনুগত দলের মত নির্বিঘ্নে অংশ গ্রহণ করেননি। উপরন্তু কূটনৈতিক নীতি ভেঙ্গে মিডিয়ার কাছে বলেছেন, ভারত চায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফের আসুক। সুজাতা সিং তাকে তাই বুঝিয়েছেন। অবশ্য ভারতের অনেক থিংক ট্যাংক এখন এটাই বলছেন। কানেক্টিভিটি থেকে শুরু করে বাণিজ্য সুবিধা সহ আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারতের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র পছন্দ আওয়ামী লীগ তা দেশটির বিভিন্ন পত্রপত্রিকার নিবন্ধে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
এরশাদ এখনও আওয়ামী লীগের কাছে ‘আনরুলিং হর্স’ হয়ে আছেন। নাকি ডার্ক হর্স হয়ে একটা সময় রাজনীতির প্রয়োজনে তিনি কিংমেকার হয়ে আভির্ভূত হবেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। এরশাদকে নিয়ে যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আগ্রহ রয়েছে তার কতটুকু অবশিষ্ট থাকবে, নাকি তিনি নিজেই অন্যদের ছাপিয়ে যাবেন এমন চিšত্মাও রাজনৈতিক মহলে ঘুরপাক খাচ্ছে।
যদিও এখন পর্যন্ত নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার থেকে হঠাৎ ইউটার্ন নেওয়ার পর জাপার কিছু প্রার্থী সরকারের বশ মানলেও, এরশাদ অনড় থাকায় বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ। এরশাদের ইউটার্নে নির্বাচনকালীন সরকার ও পুরো নির্বাচনই এখন শতভাগ প্রশ্নবিদ্ধ। এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি। এরশাদ নেই মানে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে নেই। ১৮ দলীয় জোট এবং অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এমনিতেই নেই। সর্বশেষ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনের কফিনে শেষ পেরেক এভাবে কেনো মারলেন এরশাদ তা আওয়ামী লীগ ঠাহর করতে পারেনি।
কান টানলে মাথা আসা স্বাভাবিক, তাই এরশাদকে টানাটানির পর তার দলের যেটুকু নির্বাচনে এসেছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে আওয়ামী লীগকে। রওশন এরশাদ, কাজী ফিরোজ রশিদের মত রাজনৈতিক নেতা নির্বাচনে আছেন এটা অবশ্যই বড় এক সাšত্মনা।
তবে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এসব করে জাতীয় পার্টি নিজেদের হাসির পাত্র বানাচ্ছে।’ কিন্তু রাজনীতিতে শেষ হাসি কে হাসে তা আগেভাগে কেউ হয়ত বলতে পারে না। এরশাদ কি আটক হয়েই আছেন, নাকি বহিস্কার হতে যাচ্ছেন, নাকি একজন সৈনিকের মত কখন সঠিক আঘাত হানতে পারেন তা অনুভব করা রাজনীতিকদের কাছে এখনো অপেক্ষার বিষয়।
এর আগে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দল হিসেবে অংশ নেয়। পরে জাপা থেকে জিএম কাদের মন্ত্রীত্বও গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর জাপা মহাজোট ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকারে ৬ জন মন্ত্রী নিয়ে শপথ নেয়। এরপর হঠাৎ করেই ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। ডাকযোগে পদত্যাগপত্র পাঠান গণভবনে।
তারপরও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এরশাদকে বার বার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের সিদ্বান্তে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত এরশাদকে ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এরশাদ আটক বলে দাবি করা হয়, পরে এরশাদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে ব্যাপক পোস্টারও দেখা গেছে।
জাপার একাধিক নেতা দাবি করেন, সরকার জাপার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধা দিয়েছে। অনেক আসনে জাপা প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আবেদনের পরও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতীয় এমপি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরশাদ একই পদ্ধতিতে রংপুর ও ঢাকায় প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করলেও ঢাকা-১৮ আসনের মনোনয়নপত্র গ্রহণ হয় কিন্তু রংপুরের আবেদন গ্রহণ করেননি রিটার্নিং অফিসার।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি মন্ত্রী নেই। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। সরকার গ্রহণ করেনি। আমি মন্ত্রীত্বের কোনো সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি না। আমার বাসায় পতাকা নেই। এখন গেজেট প্রকাশ করা সরকারের দায়িত্ব।’ কিন্তু সচিবালয় থেকে তা বলা হচ্ছে না। যতক্ষণ মন্ত্রীদের পদত্যাগ পত্র গৃহীত না হচ্ছে ততক্ষণ তারা মন্ত্রী আছেন আবার নেইও। আওয়ামী লীগের এ শাসনামলে সোহেল তাজের পদত্যাগপত্র থেকে শুরু করে এখন পর্যšত্ম মন্ত্রীদের পদত্যাগ করলেই বিষয়টির সাঙ্গ হচ্ছে না, তা কখন গৃহীত হবে সে জন্যে অপেক্ষার প্রহর গুনতে হচ্ছে।
জাপা নেতাদের অভিযোগ রয়েছে, ২১ জন জাপা প্রার্থীকে সরকার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি বানিয়েছে। আর ৬৩ প্রার্থীর মনোয়নপত্র প্রত্যাহার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। এই ৬৩ জনই এখন নির্বাচনে আছেন। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান বলেছেন, আমাদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে নেই মানে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে নেই। আমাদের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সকল দল নির্বাচনে অংশ না নিলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে না। উনি উনার কথা রেখেছেন। আমরা নির্বাচনে নেই। তাই জাতীয় পার্টির নামে কেউ নির্বাচনে থাকলে সেটা এরশাদ সমর্থিত হবে না। এটা হবে সরকার সমর্থিত।
তবে এরশাদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে যতই লুকোচুরি খেলুক, তাতে সরকারের যে ক্ষতি হবার তা আর পোষানো সম্ভব হচ্ছে না। এরশাদের কারণেই ১৫৪ জন প্রার্থী ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে যা নজিরবিহীন। অতীতে এরশাদের শাসনামলে মানুষ ভোটারবিহীন নির্বাচন দেখলেও এবার তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রার্থীবিহীন নির্বাচন। ফলে নির্বাচনে ৫২ শতাংশ লোক ভোটই দিতে পারছে না বলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য থাকছে না। এ কারণে ইইউ, কমনওয়েলথ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে আর পর্যবেক্ষক পাঠাচ্ছে না। ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্বে এ নির্বাচন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।