পুত্র মাহি বি চৌধুরীর কারণে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় বেকায়দায় রয়েছেন বিকল্পধারা বাংলাদেশের সভাপতি ও যুক্তফ্রন্টের চেয়ারম্যান ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বি. চৌধুরী)। ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে- এমন শর্তে বিকল্পধারার অটল অবস্থানের কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যে চাপা অসন্তোষ বিরাজ করছে। সে অসন্তোষের জের ধরে শেষতক বি. চৌধুরী একঘরে হয়ে যান কি না এ সংশয়ও দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের মনে।
জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জাতীয় ঐক্যে বিএনপিকে যুক্ত করার ক্ষেত্রে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগের শর্তকে বাড়াবাড়ি বলে মনে করছেন অনেকে। এমনকি জামায়াত প্রশ্নে বিএনপিকে কোনো ছাড় না দেওয়ার ব্যাপারে মাহি বি. চৌধুরীর অবস্থানকেও ‘অতিউৎসাহী’ বলে মনে করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মত হচ্ছে- জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় জামায়াতের কোনো জায়গা হবে না- এ অবস্থানে কারও দ্বিমত নেই। বিএনপির মতো বৃহৎ দল এককভাবে যদি ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয় তাতেই তো জোটের উদ্দেশ্য সফল হয়। কিন্তু বিএনপি জামায়াতের সঙ্গ ছাড়লেই ঐক্য প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবে-এমন শর্ত পুরো জাতীয় ঐক্যের চেষ্টাকেই ভেস্তে দেবে। বিএনপির মতো বৃহৎ দল ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছে। সে জোটে জামায়াত থাকল, না আর কে থাকল, তা নিয়ে ঐক্য প্রক্রিয়ার কিছু বলার থাকে না। জামায়াত জাতীয় ঐক্যে না থাকলেই হয়।
কয়েকটি সূত্র অবশ্য দাবি করেছে, মাহি বি. চৌধুরী জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ায় সরকারের লোক হয়ে কাজ করছেন। মাহি চাইছেন না বিএনপিকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠুক। তাই একেকবার একেক শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। কখনো দেড়শ’ আসন ছেড়ে দেওয়ার শর্ত দিচ্ছেন, আবার কখনো ক্ষমতায় গেলে প্রথম দুই বছরের জন্য দেশ পরিচালনায় ঐক্য প্রক্রিয়ার কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। আর জামায়াত ছেড়ে ঐক্যে আসার শর্ত তো প্রথম থেকেই দিয়ে আসছিলেন।
১৫ সেপ্টেম্বর ঐক্য প্রক্রিয়া ও যুক্তফ্রন্টের যৌথ সংবাদ সম্মেলনের আগের দিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠানো ‘ঘোষণায়’ জামায়াতকে ‘প্রত্যক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী’ ও বিএনপিকে ‘পরোক্ষ স্বাধীনতাবিরোধী’ বলে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ শব্দ দুটি যুক্ত করেছেন মাহি বি. চৌধুরী নিজেই। এ নিয়ে পিতা বি. চৌধুরীর সঙ্গে মাহি বি. চৌধুরীর মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হয়েছে বলে জানায় বিভিন্ন গণমাধ্যম। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রও নিশ্চিত করেছে জামায়াত ও বিএনপি ইস্যুতে পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বের কথা। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মাহি বি. চৌধুরীর কথার বাইরে যেতে পারছেন না বি. চৌধুরী। কারণ ক্ষমতাসীনদের উপরিমহলের সঙ্গে মাহি বি. চৌধুরীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। তা ছাড়া পুত্র মাহি বিকল্পধারা বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব হলেও দলের অভ্যন্তরে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ফলে মাহির অবাধ্য হতে পারছেন না বি. চৌধুরী।
জাতীয় ঐক্যে যুক্ত হতে হলে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে-এমন শর্ত সম্পর্কে জানার পর বি. চৌধুরী ও মাহি বি. চৌধুরীর তীব্র সমালোচনা করে সম্প্রতি লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ বলেছেন, বি. চৌধুরী যখন বিএনপির মহাসচিব ছিলেন তখন মুসলিম লীগের শাহ আজিজুর রহমান ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। জয়পুরহাটের রাজাকার আব্দুল আলিম ছিলেন রেলমন্ত্রী। এদের মতো অনেকেই তখন বিএনপিতে ছিলেন। এমনকি বি. চৌধুরী যখন রাষ্ট্রপতি ছিলেন তখন জামায়াতের তৎকালীন আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছিলেন মন্ত্রিসভার সদস্য। আজ কেন তিনি বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার কথা বলছেন? তার মানে বিএনপির মহাসচিব থাকা অবস্থায় সব রাজাকার ভালো ছিল এখন সব দেশদ্রোহী? এর মানে মাংস হালাল আর ঝোল হারাম।
বি. চৌধুরী তার ছেলে মাহি বি. চৌধুরীর কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন ইঙ্গিত করে অলি বলেন, অনেকের ছেলে ভিওআইপির ব্যবসা করে। ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে ব্যবসা নিয়ে ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ ছাড়া তারা আর কি চিন্তা করবে? আমাদের অনেকে তো ছেলের কাছেও বিক্রি হয়ে যাই।
২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপির শীর্ষ এক নেতা বলেন, মাহি বি. চৌধুরীর সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের উচ্চ মহলের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তাদের সঙ্গে মাহি বি. চৌধুরীর ব্যবসাও আছে। ফলে স্বার্থসংশ্লিষ্ট কারণেই সরকার বা ক্ষমতাসীনদের স্বার্থের বাইরে চিন্তা করতে পারবেন না মাহি। আর মাহির কথার বাইরেও যেতে পারবেন না বি. চৌধুরী। তারা কোনোভাবেই ২০ দলীয় জোটের ভালো চায় না। তাদের অভিসন্ধি ২০ দলীয় জোটকে ভাঙা এবং জাতীয় ঐক্যের নামে বিএনপিকে নির্বাচনে নেওয়া।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, জাতীয় ঐক্যের কারণেই বিকল্পধারা বা বি. চৌধুরীর মতো ব্যক্তি রাজনীতিতে এখনো পর্যন্ত আলোচনায় রয়েছেন। এ ঐক্য ছাড়া তাদের কোনো অবলম্বনও নেই। মাহি বি. চৌধুরীর অতিউৎসাহী অবস্থান ও আচরণের কারণে বি. চৌধুরী রাজনীতির মাঠে একঘরে বা অস্তিত্বশূন্য অবস্থায় পড়তে পারেন বলেই আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।