আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের রাজনীতিতে চলছে নানা মেরুকরণ। ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। অন্যদিকে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো চাচ্ছে যেকোনো মূল্যে পরিবর্তন ঘটাতে। আর এ লক্ষ্যেই চলছে দুপক্ষের জোর তৎপরতা।
দৃশ্যত ক্ষমতাসীনরা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে বলে মনে হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পাশাপাশি ১৪দলীয় জোটও সঙ্কটে হাবুডুবু খাচ্ছে। যেকোনো সময় রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বেগম খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে কারাবন্দি করার ফলে বিএনপি কিছুটা বেকায়দায় পড়লেও ক্ষমতাসীনরাও এ নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে রয়েছে। এরই মধ্যে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ জানিয়েছে।
নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনীতিতে ততোই উত্তাপ বাড়ছে। বলা যায়- সামনের দিনগুলোতে উত্তাপ আরো বাড়বে। এতে করে রাজনীতিতে হানাহানির শঙ্কাও কম নয়।
কেননা, বিএনপি এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে বেগম জিয়া মুক্তি না দিলে ঈদের পর তারা কঠোর আন্দোলনে যাবে। এখন দেখার বিষয় বিএনপি রাজনীতির মাঠে কতটা শক্ত অবস্থান নিতে পারে।
এ দিকে ক্ষমতার লড়াইয়ে নির্বাচনি জোট ও আসন ভাগাভাগির বিষয়টি নিয়েও তলে তলে জোট-মহাজোটে আলোচনা চলছে।
ধারণা করা হচ্ছে- বিগত নির্বাচনের মতো আগামী নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির (জাপা) সঙ্গে আসন সমঝোতায় যেতে পারে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে বিষয়টি পুরোপুরি নির্ভর করছে নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানে ওপর।
চলতি বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে নির্বাচনী জোট নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে জোর আলোচনা চলছে। একইসঙ্গে আলোচনা চলছে আসন সমঝোতার বিষয়টি নিয়েও।
বিগত দু’টি নির্বাচনেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি আসন সমঝোতার ভিত্তিতে অংশ নিয়েছে। আগামী নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির সঙ্গে আসন সমঝোতার ব্যাপারে দলটির অবস্থান ইতিবাচক। তবে এক্ষেত্রে নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে কি-না, তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে বলে জানাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারক নেতারা।
ক্ষমতাসীন দলটির কয়েকজন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আসন সমঝোতার বিষয়টি কী হবে সেটা নির্ভর করবে নির্বাচনে বিএনপির আসা না আসার ওপর। অথবা নির্বাচনে এলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের পরিধি কী হবে, সে বিষয়টিও আওয়ামী লীগের চিন্তা-ভাবনা ও বিবেচনায় রয়েছে।
গত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল জোটগতভাবে অংশ নেয়। এর আগে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে থেকে জাতীয় পার্টি আসন সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশ নেয়। গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টি জোটের বাইরে থাকলেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে। বর্তমানে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। একইসঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায়।
এদিকে নির্বাচনের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বেগম জিয়ার মুক্তির বিষয়টি। অবশ্য বিএনপি বলছে- ফাঁকা মাঠে আর কাউকে গোল দিতে দিবে না। ফলে অনুমান করা যায় আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়টি অনেকটাই চূড়ান্ত।
তবে কি প্রক্রিয়ায় এবং কোন কৌশলে দলটি নির্বাচনি রাজনীতিতে এগুবে তা এখনো পরিষ্কার নয়। তা দৃশ্যত হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।
ঈদের আগে অনেক চেষ্টা করেও খালেদা জিয়াকে কারামুক্ত করতে পারেনি বিএনপি। বর্তমানে খালেদার অবস্থা ভাল নেই। ক্রমেই নানা রোগ বাসা বেঁধে শরীরে।
এদিকে ঈদের দিন কারাগারে বন্দি বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে দেখেই স্বজনরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যের ভগ্নদশা দেখে স্বজনদের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খালেদা জিয়া তাদেরকে আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে ধৈর্য ধরতে বলেন।
ঈদের দিন জোহরের নামাজের পর কারাগারে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে যাওয়া এক স্বজন ইনকিলাবকে এসব কথা বলেছেন। তিনি জানান, ছোট ভাইসহ তাদের সন্তানরা খালেদা জিয়াকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেন। তিনি স্বজনদের নাম ধরে সবার খোঁজ-খবর নেন। বিশেষ করে শিশু-বাচ্চারা কেমন আছে জানতে চান। খালেদা জিয়া পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দেশবাসী ও দলের সিনিয়র নেতাসহ সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দোয়া চেয়েছেন।
খালেদা জিয়ার পরিবারের ২০ জন সদস্য কারাগারে তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে যান। স্বজনদের মধ্যে ছিলেন খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ এস্কান্দরের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার ও তার ছেলে শামস এস্কান্দার, শাফিন এস্কান্দার, ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা, ছেলে অভিক এস্কান্দার, এরিক এস্কান্দার, ভাগ্নি অরনি এস্কান্দার, অনন্যা এস্কান্দার, শাফিয়া ইসলাম, ভাগিনা সাইফুল ইসলাম ডিউক, মো. মেহরাব ও মো. আল মামুন, বড় ছেলে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের বড় বোন শাহিনা খান জামান বিন্দু, তার স্বামী শফিউজ্জামান। দলের চেয়ারপার্সনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার, গুলশানের বাসভবন ‘ফিরোজা’র গৃহকর্মী ও গাড়ি চালক। খালেদা জিয়া কারাগারে আসা স্বজনদের সাথে বসে বাসার রান্না করা খাাবারও খেয়েছেন। তারা সবাই প্রায় আড়াই ঘণ্টা খালেদা জিয়ার সাথে কারাগারে অবস্থান করার পর বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে কারাফটক দিয়ে বেরিয়ে আসেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, খালেদা জিয়া ঈদের দিনে যেসব খাবার পছন্দ করেন, সেগুলো তারা রান্না করে এনেছেন। ওইসব খাবার ভেতরে নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ পরীক্ষা করে। তারা জানান, বেগুনি সাদা অর্কিডের একটি ফুলের তোড়া দিয়ে খালেদা জিয়াকে ঈদের শুভেচ্ছা জানান স্বজনরা।
খালেদা জিয়া বোন, ভাবী ও স্বজনদের বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এক সাথে অনেক স্বজনকে পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। স্বজনদের একজন ইনকিলাবকে বলেন, তারা খালেদা জিয়ার জন্য তার পছন্দের মিষ্টি এবং সেমাই রান্না করে নিয়ে যান। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মিলে মিষ্টি-সেমাই খেয়েছেন। তবে শারীরিক অসুস্থতার কারণে ভালো করে খেতে পারেননি। তিনি বলেন, কারাগারের ভেতরে প্রবেশের পর স্বজনদের দেখে খালেদা জিয়া আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তাঁর স্বাস্থ্যের ভগ্নদশা দেখে সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ অভিযোগ করে স্বজনরা বলেন, তার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। তিনি কারও সাহায্য ছাড়া দাঁড়াতে পারেন না। নিজের কক্ষ থেকে অসুস্থ শরীর নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাতের জন্য আসেন। তাকে দুই পাশ দিয়ে দুই জন ধরে নিয়ে আসেন সাক্ষাতের নির্ধারিত কক্ষে। তাঁর মনটাও ভালো ছিলো না। ঈদের দিন তিনি নতুন শাড়ি পরেননি। স্বজনরা যে যার মতো খালেদা জিয়ার পছন্দের খাবার রান্না করে নিয়েছিলেন। সেই খাবার সবাই একত্রে খেয়েছেন। তবে খালেদা জিয়া খেয়েছেন সামান্য।
নতুন শাড়ি না পরার কারণ জানতে চাইলে ওই স্বজন বলেন, ‘নির্যাতন এবং কারাবন্দী অবস্থায় নতুন শাড়ি পরে আনন্দ করার মনোভাব থাকে না।’ তিনি আরও বলেন, নিকটাত্মীয়দের দেখে একপর্যায়ে খালেদা জিয়ার মন কিছুটা ভালো হয়। পরিবারের সদস্যরা জানান, দলের সিনিয়র নেতারা দুপুরে কারাফটকে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুমতি না পাওয়ার বিষয়টি খালেদা জিয়া শুনেছেন। এ জন্য হতাশা প্রকাশ করেন।
খালেদা জিয়া পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে দেশবাসী, দলের সিনিয়র নেতাসহ সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে দোয়া চেয়েছেন। এদিকে ঈদের দিন সকাল ১০টা থেকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা কারাগারের সামনে আসবে- এমন কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা জোরদারের অংশ হিসেবে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান।
প্রসঙ্গত গত ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ৫ বছরের সাজার পর বিএনপি চেয়ারপারসন নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কারগারে বন্দি রয়েছেন।
এ নিয়ে চলছে রাজনীতিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা। সেই সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি। এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত রাজনীতিতে কী ঘটে। ক্ষমতার মসনদে কারা বসেন।