স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে। তবে, ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা তো নয়ই, কাউকে আটকের ক্ষমতাও থাকবে না দেশরক্ষায় নিয়োজিত এই বাহিনীর। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এই বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সেনা মোতায়েনের বিষয়ে গণপ্রতিধিত্ব আদেশে (আরপিও) কোনও সংশোধনীও আনা হবে না। সশস্ত্র বাহিনী ইসির নির্দেশমতো একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের অধীনে সংশ্লিষ্ট এলাকায় দায়িত্ব পালন করবে। এই বাহিনী কেবল নির্বাচনি এলাকায় টহল দিতে পারবে। প্রবেশ করতে পারবে না কোনও ভোট কেন্দ্রের ভেতরে। নির্বাচন কমিশন সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের পক্ষে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তারা বারবারই বলে আসছে জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের বিষয়টি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সেনা মোতায়েনে প্রকাশ্য বিরোধিতা নেই। তবে, বিতর্ক রয়েছে প্রক্রিয়া নিয়ে। প্রক্রিয়ার বিষয়টি দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও বিষয়টি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির পক্ষ থেকে সেনাবাহিনীর হাতে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ বলছে, কোনোভাবেই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। তারা চায় নির্বাচনের মাঠে সেনা থাকবে ফৌজদারি কার্যবিধির এখতিয়ারের আওতায়।
বাংলাদেশের বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত ১০টি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে আটটিতেই সেনা বাহিনী দায়িত্ব পালন করেছে। তবে, তাদের দায়িত্বের প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। সংসদ নির্বাচনের মধ্যে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয়, ১৯৮৬ সালে তৃতীয় ও ১৯৮৮ সালের চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে সেনা বাহিনী মোতায়েন করা হয়নি। ওই সময় দেশে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা থাকায় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অবশ্য ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের সময় সামরিক আইন বলবৎ থাকায় নির্বাচনের দায়িত্বে না থাকলেও সেনা বাহিনী সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিল।
নির্বাচন কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, সেনাসদস্যরা ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই সময় তারা পুলিশের মতো পরোয়ানা ছাড়াই অপরাধীকে আটক করে থানায় সোপর্দ করার সুযোগ পেয়েছেন। ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম ও ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ৬ষ্ঠ ও সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯/১৩০ ধারা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ইনস্ট্রাকশন রিগার্ডিং এইড টু সিভিল পাওয়ার’ অনুসারে সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করা হয়। তারা নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত শুধু ‘শো অব ফোর্স’ হিসেবে এবং নির্বাচনের দিন ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে দায়িত্ব পালন করে। এক্ষেত্রে তাদের কাউকে বিনা ওয়ারেন্টে গ্রেফতারের সুযোগ ছিল না।
তবে, নির্বাচনে সেনা নিয়োগে ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম সংসদ নির্বাচনে হয় ভিন্ন বিধান। ওই নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশের মাধ্যমে আরপিও সংশোধন করে সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর ফলে ওই নির্বাচনে সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় অন্যান্য বাহিনীর মতো সেনাবাহিনীসহ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতারের ক্ষমতা পান। একই প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু বিদায়ী রকিব উদ্দিন কমিশন আরপিও সংশোধন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞা থেকে আবারও সশস্ত্র বাহিনীকে বাদ দিয়ে দেয়।
বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে যাদের বোঝানো হয়েছে, তাদেরই নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কাউকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেফতার করার ক্ষমতা রয়েছে। এক্ষেত্রে পুলিশ ছাড়াও আনসার, ব্যাটালিয়ন আনসার, বিজিবি, র্যাব ও কোস্টগার্ড সদস্যদের এই ক্ষমতা আছে। সেনাবাহিনীর তা নেই।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হলেও সেটা ছিলো ফৌজদারি কার্যবিধির বিধানের ক্ষমতা বলে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯, ১৩০ ধারা অনুসারে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলায় বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য কোনও ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন এলাকার পুলিশ কমিশনার সেনাবাহিনীর সহায়তা নিতে পারেন।
দশম সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট ১৫ দিন মাঠে ছিল। তারা সাধারণ এলাকায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও মেট্রোপলিটন এলাকায় কমিশনারের অধীনে দায়িত্ব পালন করেন। ফৌজদারি বিধির আলোকে মোতায়েন করা সেনাবাহিনী ২০১৪ সালের নির্বাচনে মূলত স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করে।
ওই নির্বাচনের আগে কমিশন জারিকৃত এক পরিপত্রে বলা হয়, সশস্ত্র বাহিনী রিটার্নিং অফিসারদের (মূলত জেলা প্রশাসক) সার্বিক সমন্বয়ে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করবে। তারা প্রতিটি জেলা/উপজেলা/ মেট্রোপলিটন এলাকার নোডাল পয়েন্টে এবং অন্যান্য সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত থাকবে। রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োজন অনুসারে উপজেলা/থানায় সশস্ত্র বাহিনীকে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োগ করা হবে। রিটার্নিং অফিসার চাইলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে তারা সহায়তা দেবেন। রিটার্নিং অফিসার বা প্রিজাইডিং অফিসারের চাহিদা ছাড়া সশস্ত্র বাহিনী ভোট কেন্দ্রের ভেতরে কিংবা ভোট গণনা কক্ষে কোনও দায়িত্ব নিতে পারবেন না। উপকূলবর্তী এলাকায় নৌবাহিনী স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। ঝুঁকির বিবেচনায় প্রতিটি জেলায় নিয়োজিত সেনা সদস্যের সংখ্যা রিটার্নিং অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে কম বেশি করা যাবে। সেনা সদরের বিবেচনায় প্রতিটি স্তরে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সেনা সদস্য সংরক্ষিত (রিজার্ভ) হিসেবে মোতায়েন থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ সড়ক/মহাসড়কগুলোতে সেনা সদস্যরা নিরাপদে যান চলাচল এবং স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে কাজ করবেন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ/মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগে জয়েন্ট কোর্ডিনেশন সেল স্থাপন করতে হবে। এই সেলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয়, সোনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ অন্য সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধি থাকবেন। বিমান বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক হেলিকপ্টার ও পরিবহন বিমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও বাহিনী সমূহের অনুরোধে উড্ডয়ন সহায়তা দেবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের কাজে যাবতীয় সহায়তা দেবে।
ওই নির্বাচনে সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। এক্ষেত্রে প্রতিটি জেলা একটি ব্যাটালিয়ন (৭৪০ সদস্য) ও প্রতিটি উপজেলায় এক প্লাটুন (৩৫ জন) সেনা সদস্য দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ নির্বাচন ছাড়াও তার পরপর ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও একই আইনের বিধানে মাঠে সেনাবাহিনী ছিল। সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় সরকার পরিষদের ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছিল।
কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও তারা ফৌজদারি কার্যবিধির আলোকে সেনা মোতায়েন করতে চায়। এক্ষেত্রে তারা স্ট্রাইকিং বা রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কেন্দ্রের বাইরে থেকে দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনি এলাকায় টহল দেবে। কোথায় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে তো প্রশমনে অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করবে। জানা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও সেনা মোতায়েনে ইসির মতের সঙ্গে অনাপত্তি রয়েছে। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপের সময় তারা সেনা মোতায়েন ইস্যুতে ফৌজদারি কার্যবিধির ওই ১২৯-১৩১ ধারার বিধানটির কথা মনে করিয়ে দিয়ে এসেছে। ইসিতে দেওয়া লিখিত প্রস্তাবে এ বিষয়ে তারা বলেছেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে কোনও পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যের নিয়োগ করা যাবে, যা ১৮৯৮ সালের প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২৯-১৩১ ধারায় এবং সেনা বিধিমালায় In aid civil power শিরোনামে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।’
এদিকে বিএনপি সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে (আটক ও তাৎক্ষণিক বিচারের ক্ষমতা) মোতায়েনের দাবি তুলেছে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের মতে, ‘নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে সেনা মোতায়েন সম্ভব নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সেনা নিয়োগ করে উদ্দেশ্য হাসিল হবে না।’ বাংলা ট্রিবিউনকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সুযোগ রয়েছে। তবে, তাদের হাতে কখনোই ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার সুযোগ নেই। অতীতেও ছিল না। না বুঝেই এই দাবি তোলা হচ্ছে। রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামিয়ে কোনও লাভ নেই। সেনাবাহিনীকে পুলিশের মতো গ্রেফতারি ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামাতে হবে। কারণ নির্বাচন একটি দ্রুতগতির বিষয়। কোনও কেন্দ্র দখল হয়ে যাওয়ার পরে ম্যাজিস্ট্রেটকে সংবাদ দেওয়ার পরে সেনাবাহিনী মুভ করবে—এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এতে ভোটকেন্দ্র দখল ঠেকানোর মতো কাজে তারা কোনও ভূমিকা রাখতে পারবে না।’
নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কমিশন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে। তবে, কোন প্রক্রিয়ার নিয়োগ হবে, সেটা বলার সময় এখনও আসেনি। তফসিল ঘোষণার সময় এটা জানা যাবে। আর যাই হোক, বিদ্যমান আইনের আলোকেই হবে।’ আরপিওতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করার কোনও সম্ভাবনা নেই বলেও মন্তব্য করেন ইসির এই মুখপাত্র।
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা একাধিক বার জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের কথা জানিয়েছেন। সর্বশেষ বরিশাল গিয়ে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা হবে না। তবে, জাতীয় নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকবে।’
রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ শেষে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনেও গত বছরের শেষ দিকে সিইসি সংসদ নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের নীতিগত অবস্থানের কথা জানিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি বলেছেন, ‘সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা নির্বাচনকালে সেনাবাহিনার ভূমিকা নিয়েও কথা বলেছেন। এটা থাকবে কি থাকবে না, তা বলেছেন। অধিকাংশ বক্তাই একটি আইনগত সীমারেখার মধ্যে থেকে সেনাবাহিনীকে নির্বাচনে দায়িত্ব পালনের সুযোগের কথা বলেছেন। তবে কেউ কেউ সেনাবাহিনী বিপেক্ষও মত দিয়েছেন। সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করলে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর ক্ষমতা খর্ব হবে। তারা দায়িত্ব পালনে উৎসাহ হারাবে।’