ব্রেকিং নিউজ
Home / Blog / মেহেদী ভাই, যদি ভুল হয় ক্ষমা করবেন?

মেহেদী ভাই, যদি ভুল হয় ক্ষমা করবেন?

• এনাম চৌধুরী •

Enam Chowdhury

Enam Chowdhury

‘আদার ব্যাপারী হইয়া তুমি জাহাজের খবর নেয়ার দরকার নাই’-বাক্যটির সাথে পরিচয় হয়েছিলো কিংবা ঘটেছিলো মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম জীবনে। ভাব সম্প্রসারণ পড়তে গিয়ে ঐ বাক্যটিকে যখন প্রথম পড়েছিলাম তখন মনে হয়েছিলো আল্লাহ বুঝি বড় কঠিন একখান পরীক্ষায় ফেললেন ? এমন জটিল আর কঠিন বাক্য কেন কোন বা উদ্দেশ্যে পন্ডিত মশাই আমাদের মত মাধ্যমিক স্কুলের সহজ-সরল ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য আবিস্কার করলেন ?

পরক্ষণে আবার মনে হয়েছিলো, যেহেতু বাক্যটি আমাদের মত ছয় নম্বর ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বাংলা ব্যাকরণের মহা সম্পদনা পরিষদ বাঁচাই করিয়া লিপিবদ্ধ করেছেন, মনে হচ্ছে এতে খুব বেশী কঠিন কিংবা জটিলতার কিছু অবকাশ থাকবে না। মাথার মধ্যে যখন এতোসব প্রশ্নের ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখনই নূরুল ইসলাম গাভুরটিকী’র স্যার ছড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে ক্লাসে ঢুকে সবার কাছে জানতে চাইলেন সবার কি প্রশ্নের উত্তর শেখা হয়েছে, অর্থাৎ ভাব সম্প্রসারণের মূল বক্তব্য কি লিখতে পারবে ?

তখন কিছুটা পিন পতন নিরবতা পুরো ক্লাসে। কেউ কিছু বলছে না। ক্লাসের সবার দিকে যেন এক নজর চোখ বুলিয়ে নিলেন স্যার। তারপর স্যার তার বিখ্যাত একটি হাসি দিয়ে বললেন, ‘বুঝেছি তোমাদের মাথার ঘিলুতে বাক্যটি গিয়ে হিট করতে পারেনি। ঠিক আছে আমি মগজের ভিতর ঢুকাইয়া দিচ্ছি’।

সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার গাভুরটিকী গ্রামের বাসিন্দা আমাদের ঐ স্যারের নাম নূরুল ইসলাম। গ্রামের নামে তাঁর নামের পেছনেও গাভুরটিকী লেগে সবাই স্যারকে এক বাক্যে এক নামে চিনতো ‘গাভুরটিকীর স্যার’ হিসেবে। স্যার আজ পৃথিবীতে নেই। আল্লাহ আমাদের ঐ প্রিয় স্যারকে জান্নাত নসীব করুন। প্রচন্ড দরদী এবং আল্লাহ ওয়ালা মানুষ ছিলেন স্যার। খুব স্নেহ দিয়ে পড়াতেন ছাত্রদের। স্যার প্রতিদিন চার মাইল পায়ে হেটে আসতেন স্কুলে। এতো ক্লান্তি, মেঘ-বৃষ্টি যেন স্যারকে আগলে রাখতে পারতো না।

সেদিন স্যার আদার ব্যাপারী হয়ে ……….. বাক্যটির পুরো বাক্য বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

পাঠকের প্রশ্ন জাগতে পারে হঠাৎ করে কেন আদার ব্যাপারীর এতো ব্যাখ্যা নিয়ে আসলাম! প্রকৃত অর্থে সাংবাদিকতার বয়স এখন সতের বছর। দুই হাজার ষোল সালে দেড় যুগ পালন করতে পারবো যদি বেঁচে থাকি। দুই প্রায় ঐ দেড় যুগে এখনো মাঝে মাঝে মনে হয় কিছুই শিখতে পারলাম না। ক্লাস এইটে পড়ার সময় সাংবাদিক হিসেবে মফস্বলের একটি উপজেলা থেকে শুরু হয়েছিলো সংবাদ লেখার কাজ। মাধ্যমিক স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারা আমাকে তখন মাঝে মাঝে প্রচন্ড ঝড়-তোফান পরিস্থিতি পার হতে হয়েছে। সাংবাদিক তাইছির মাহমুদ ভাই হয়তো স্মরণ করতে পারবেন তখন আলহাজ্ব জহিরুল হক চৌধুরী সিলেট বাণীর সম্পাদক। চৌধুরী আমিরুল ভাই বার্তা সম্পাদক এবং তাইসির ভাই সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার। আমি বালাগঞ্জ (ওসমানীনগর) থেকে দুপুর বেলা সিলেট যেতাম। সন্ধ্যার পর বাণী অফিসে গিয়ে আমার লেখা আর্টিকেলটি বার্তা সম্পাদক আমিরুল ভাইয়ের হাতে দিতাম। তখন আমার লেখার দৈর্ঘ্য-প্রস্ত নিয়ে হান্নান ভাই (এখনো সিলেট বাণীর নির্বাহী সম্পাদক আছেন) ঋষিকেষ রায় সংকর দাদা অনেক মজা করতেন। মাঝে মাঝে তাইসির ভাইয়ের টেবিলের সামনের চেয়ারে ছড়াকার কবি সুফিয়ান আহমদ চৌধুরীর সাথে দেখা হতো। আড্ডা প্রিয় সুফিয়ান চৌধুরী জমিদার পুত্র। বিশ্বনাথের চান্দ ভরাং এর জমিদার ছুটু মিয়ার পুত্র সুফিয়ান চৌধুরীর বাবার উত্তরসূরী হিসেবে জমিদার না হলেও তার লাইফ স্টাইলে জমিদারীর আকার-ইঙ্গিত বুঝা যায়। সুফিয়ান চৌধুরীকে মামা ডাকতাম। দারুণে আড্ডাবাজ এবং আমুদে প্রকৃতির সুফিয়ান মামাকে পেলে সময় কোন দিকে চলে যেতো বুঝাই যেতো না। সুফিয়ান মামার সাথে আড্ডার একটি বিশেষ স্থান ছিলো জিন্দাবাজারের পঞ্চখানা রেস্টুরেন্ট। পঞ্চখানার হালিম ও রুটি দিয়ে সন্ধ্যার পারে আমাদের আড্ডা খুব জমে উঠতো। ঐ আড্ডায় মাঝে মাঝে লেখক কবি মুসলেহ উদ্দিন বাবুল ভাই আসতেন। মাঝে মাঝে আমরা প্রীতিরাজ রেস্টুরেন্টে শিক্কাবাব কিংবা বিরানী খেতাম।

আমার লেখার মূল বিষয়বস্তু থাকতো প্রবন্ধ। সুফিয়ান মামা আমাকে প্রায়ই বুঝাতেন ছড়ার মহত্ব। মামা যে কৌশলে আমাকে ছড়া লেখার প্রতি যে আকৃষ্ট করতে চাইতেন সেটা আমি বুঝতাম। তিনি বলতেন, অল্প কথায় ছড়ায় ছন্দে মানুষকে অনেক ম্যাসেজ দেয়া যায়। ছড়া লিখো। কালি প্রসন্ন দাস, সুকুমার বড়–য়ারা কত বিখ্যাত হয়েছেন দেখেছো। মামাকে বলতাম, আসলে মামা আপনার ছড়াগুলো দারুণ লাগে কিন্তু আমি যে ছড়া লিখবো সেটা মাথায় ঢুকে না আমার। প্রবন্ধ লিখতেই আমার ভাল লাগে।

ঈদের সময় সর্ব প্রথম সুফিয়ান মামার দেয়া পাঞ্জাবী উপহার পেতাম। মধুবন মার্কেট থেকে কিংবা জিন্দাবাজারের শুকরিয়া মার্কেটের পাঞ্জাবী মহল থেকে মামা নিজে গিয়ে কিনে দিতেন পাঞ্জাবী। প্রায়ই দেখতাম সুফিয়ান মামা এবং তাইসির ভাইর মধ্যে দারুন আমুদে আড্ডা।

সাংবাদিকতা জীবন ছাত্র থাকা অবস্থায় শুরু হওয়ার কারণে বাংলাদেশের তথাকথিত নোংরা ছাত্র রাজনীতি নামক ভন্ডামী চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা ইভটিজিং নামক মহা চাকুরীর সাথে আমার খুব একটা ভাব হয়নি। তবে রাজনীতির ঐ নোংরা খেলোয়াড়দের কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। দেখেছি অনেক ছাত্রনেতাদের যারা প্রতিমাসে বান্ধবী পরিবর্তন করতেন। অনেককে দেখেছি মেয়ে বান্ধবী সহ ফুর্তি করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দিন-দপুরে আটক হয়ে ধোলাই খেতে।

মজার বিষয় হচ্ছে, ইদানিং আমারই কিছু ‘পেশাদার’ সহকর্মী যারা ভাবে ইতিহাসের মহাপন্ডিত সাংবাদিক আমাকে মৌলবাদী কিংবা ছাত্র-শিবিরের সাবেক নেতা বানাতে দারুন উঠে পড়ে লেগেছেন। কারণ ব্লগার পরিচয়ের কথিত নষ্টদের নোংরামীর বিরুদ্ধে আমি সাংবাদিক এনাম চৌধুরী সব সময়ই সোচ্ছার। তাই তাদের ভাব এমনই যে, ঐ বেটাকে জামায়াত-শিবির বানাতে পারলে কেল্লাফতে।

একটি বিষয় মাথায় মনে হয় এদের ঢুকে না, জামায়াত কিংবা শিবির যারা করেন তাদের রাজনীতির আর বাম কিংবা আওয়ামীলীগের রাজনীতির মধ্যে প্রার্থক্য বুঝতে কি তাদের বেশী অসুবিধা হয়। জামায়াত ব্যক্তির পূঁজার বাইরে একটি টার্গেট নিয়ে রাজনীতি করছে আর উনারা টাকা বানানোর মেশিন হিসেবে ব্যক্তি পূঁজা এবং রাজনীতি দুটোই এক সাথে করেন।

এবার ফিরছি একটি উল্টে কিংবা-পাল্টে যাওয়ার ছোট ঘটনায়। বিষয়টি আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে।

ব্রিটেনের প্রায় ছয় বছর জীবনে সংবাদপত্রের সাথে সখ্যতা কিংবা সম্পর্ক আমার একদিনের জন্যও দূর হয়নি। সংবাদপত্র এবং আমার জীবন যেন একই সুঁতোয় গাঁথা। আর সে সূত্রে কত কিছু দেখছি ভাষায় বুঝাতে পারিনা মাঝে।

গত ১৯-২৫ জুন সংখ্যা সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার ৩৩ নম্বর পাতায় একটি কলাম দেখলাম এবং পড়লাম। যার শিরোনাম ছিলো “ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাঙালীদের আস্থাহীনতার পাত্র করেছেন লুৎফুর।” লিখেছেন কামাল মেহেদী। যাকে আমি মেহেদী ভাই বলে ডাকি। নিতান্ত ভদ্র এবং অমায়িক প্রকৃতির মানুষ। খুব বেশী দিন হয়নি ব্রিটেনের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল এস ত্যাগ করে এটিএন বাংলা ইউকেতে যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি একটি অনলাইন পত্রিকার সম্পাদকও তিনি। কামাল ভাইয়ের লেখা পড়ে মনে হয়েছে বৃটিশ রাজনীতির কোন খলনায়কের চরিত্র নিয়ে তিনি বিশেষ রচনা লিখে ব্রিটিশ বাঙালীদের তিনি বিশেষ দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। বিষয়টি অবশ্যই সমাজ সচেতনতামূলক। কিন্তু উল্টে কিংবা পাল্টে যাওয়ার যে বিষয়টি বলছিলাম সেটি হলো, মাত্র এক বছর আগের কথা। কামাল মেহেদী ভাই টাওয়ার হেমলেটস কাউন্সিল এবং লুৎফুর রহমান (সাবেক মেয়র) নিয়ে যে রিপোর্ট বা স্টোরিগুলো করতেন এর প্রতিটিই ছিলো মেয়র লুৎফুর রহমানের কাজের গুনগানে ভরপুর। কামাল মেহেদী ভাই চমৎকার রিপোর্ট করতেন যেগুলোতে আলোচনা ছিলো শতভাগ কিন্তু সমালোচনার লেশ মাত্র ছিলো না। লুৎফুর রহমানের কাজের প্রশংসা ভরপুর রিপোর্টগুলো যে বারায় লুৎফুর প্রীতি বাড়াতে সহায়ক ছিলো সেক্ষেত্রে না বলার অবকাশ থাকে না।

প্রশ্ন হচ্ছে যদি মেয়র লুৎফুর রহমানকে এতোটা ভুল পথে হাটতে দেখেছিলেন তবে কেন লুৎফুর রহমানের ভুলগুলো ধরিয়ে দিতে বেশ দৈর্ঘ্য-প্রস্তের একটি সমালোচনামূলক আর্টিকেল কোন পত্রিকায় লিখলেন না কিংবা চ্যানেল এস-এ একটি তথ্য বহুল প্রতিবেদন কিংবা ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট প্রচার করে চমৎকারভাবে বললেন না “ব্রিটিশ রাজনীতিতে বাঙালীদের আস্থাহীন করছেন লুৎফুর” দেখা যাক সামনের দিনগুলো কেমন যায় কামাল মেদেহীর, চ্যানেল এস নিউজ, লন্ডন।”

তখন বলেন নি এখন বলছেন। মেহেদী ভাই সেই স্ট্রীম পলিটিক্স এবং লেবার পার্টির ইদানিংকালের ঐ শব্দটি মনে হয় আরো একটু পপুলার করার প্রয়াস চালিয়েছেন। কিন্তু বড় ভাই একটি বারও লিখলেন না লেবার পার্টি ঐ আলোচিত ব্যক্তি লুৎফুর রহমানের সাথে কি খেলাটি করেছিলো দুই হাজার দশে। তারা সর্বাধিক ভোট পাওয়া মেয়র প্রতিদ্বন্ধিতা প্রত্যাশী লুৎফুর রহমানের সাথে কি সেদিন কোন নৈতিক আচরণ কিংবা সুবিচার করেছিলো ? হেলাল আব্বাস সেদিন কোন নৈতিকতা নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন ? কিভাবে লেবার পার্টি তাকে প্রার্থী দিয়েছিলো। ঐ প্রশ্নগুলোতে নিজ লেখায় বা বলায় একবারও কোঁথায় বলেন নাই ! অথচ আস্থা-অনাস্থার মধুর বচন দিয়ে আমাদের প্রাণ শান্ত করার প্রয়াস চালালেন মেহেদী ভাই।

আচ্ছা মেহেদী ভাই- লুৎফুর রহমানতো লেবার পার্টির টাওয়ার হেমলেটস এর লীডার ছিলেন। ইতিহাস তো দূরে নয়, লেবার পার্টির টাওয়ার হেমলেটস এর কিছু তথা-কথিত সুনীতির (?) কারণেই লিবডেম কিন্তু পুরো ম্যালবারী প্লেস এর নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলো। আজ যারা নির্বাহী মেয়র হওয়ার জন্য নির্বাচন করেছেন তাদের সবাই (লেবার পার্টির) ইয়েস ফর মেয়র এর পক্ষের ছিলেন না। আপনি তো ঐ বিষয়গুলো স্পর্শই করলেন না ! আপনার সহজ-সরল বক্তব্য হলো লুৎফুর রহমান ভালো ছিলেন না ?

ভাই দুর্নীতির সংজ্ঞা ইদানিং একটু ভিন্ন ভিন্ন যেন মনে হয়। নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের রায়ে লেখা আছে লুৎফুর আর্থিক বিষয়ে দুর্নীতিগ্রস্থ নন কিংবা এক্টিমিস্ট নন।

লুৎফুর যদি কোন রাজনৈতিক দলগড়ে নেতা হতে চান তবে সেটা খারাপ হবে কেন ? তিনি তো লেবার পার্টির কর্মী কাউন্সিলর, লীডার ছিলেন। এদেশের আইন মেনে যা করা হবে, তাইতো মেইনস্ট্রাম। শুধুমাত্র লেবার, কনজারভেটিব, লীডডেম, ইউকিপ করলেই কি মূলধারা ? বাকীদের কি অধিকার নেই। নাকি বাংলাদেশের আ’লীগ-বিএনপির ক্ষমতার রাজনীতির মত যে দল ক্ষমতায় যাবে সে দলের মেয়র, চেয়ারম্যান, মেম্বার না হলে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে ?

মেহেদী ভাই, চ্যানেল এসের ঐ রিপোর্টগুলো এবং আপনার সাম্প্রতিক লেখাটির তাল মেলাতে পারিনি বলেই লিখলাম কথাগুলো। দুঃখ পেলে আপনার রিপোর্টগুলোর মতো ভুলে গিয়ে ক্ষমা করবেন।

লন্ডন ২৪ জুন, ২০১৫, 

লেখক ঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট