কারাবন্দি এবং বিদেশে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসীরা আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে বলে একাধিক প্রার্থী অভিযোগ করেছেন। দূর থেকে তারা মোবাইল ফোনে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের মাঠে নামার নির্দেশনা দিচ্ছে। ফোন পেয়ে সাভার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও টঙ্গীতে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীরা রাজধানীতে ঢুকছে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তার সমর্থকদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। নানা ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী মিছিল ও পথসভায় অংশ নিচ্ছে ভয়ংকর সব সন্ত্রাসী। এ পরিস্থিতিতে হুমকির শিকার প্রার্থীরা ভোটের দিন কেন্দ্র দখল, হামলা এবং প্রাণহানির আশংকা করছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্য এবং গোয়েন্দা সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, নির্বাচন উপলক্ষে রাজধানীতে ব্যাপক হারে অবৈধ অস্ত্র ঢুকেছে। সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে ঘুরছে এসব আগ্নেয়াস্ত্র। পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র অবস্থায় মহড়া দিচ্ছে। প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের ভয় দেখাচ্ছে। এদের ভয়ে একাধিক প্রার্থী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে তারা জানান। তাদের মতে, নির্বাচনের শুরুর দিকের চেয়ে বর্তমানে সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
সন্ত্রাসীরা যে সিটি নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, তারা নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করছে এবং অবৈধ অস্ত্র সংক্রান্ত বেশ কিছু অভিযোগ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতেও পৌঁছেছে। তাদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক উইং কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ভোট কেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করতে অভিযান অব্যাহত আছে।
শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ ও খোরশেদ আলম রাশু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি। কারাবন্দি জোসেফ তার সহযোগীদের মোহাম্মদপুর ও আদাবর থানা এলাকার পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামার নির্দেশনা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। জোসেফের ঘনিষ্ঠ একজন জানিয়েছেন, তারা মোবাইল ফোনে বসের নির্দেশ পেয়ে এক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করছে। রাশুর এক ঘনিষ্ঠ সহচর জানায়, তারা বসে নেই। নির্বাচনে কাজ করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ আসে বসের কাছ থেকে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম মহাখালী ও গুলশান এলাকায় পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে, কিলার আব্বাস কাফরুল এলাকায় ও আকতার মহাখালী এলাকায় তাদের পছন্দের প্রার্থীদের হয়ে সহযোগীদের মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফ ও খোরশেদ আলম রাশু কারাগারের দুই প্রান্তে রয়েছে। তাদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রাখা হয়েছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিদিন সার্চিং ও নজরদারি করা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম সন্ত্রাসী জিসান দুবাই পলাতক রয়েছে। মানিক রয়েছে মালায়েশিয়ায়। বিদেশ থেকে তারা শাহজাহানপুর, গোড়ান ও খিলগাঁও এলাকায় তাদের পছন্দের কাউন্সিলর প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামার জন্য দেশে থাকা সহযোগীদের নির্দেশনা দিচ্ছে। অনেক প্রার্থী তাদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ রাখছেন। পছন্দের প্রার্থীদের সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন পলাতক এই সন্ত্রাসীরা। খিলগাঁওয়ের এক কাউন্সিলর প্রার্থীর সঙ্গে জিসানের হটলাইন দীর্ঘদিনের। জিসানের সহযোগীরা অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে এলাকায়। মিছিল-মিটিংয়ে কোমরে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে। এছাড়া শুভ, অনিক, রাজু, জুয়েল, শোভন, আলী, বাদশা, রূপম ও রাজিবসহ অন্তত ৩০ জন ক্যাডার বাহিনী এসব এলাকার প্রার্থীর পক্ষে রয়েছে।
২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম সন্ত্রাসী লেদার লিটনও বিদেশে পলাতক। বিদেশে থেকে চকবাজার, লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচর এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। ফলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা আতংকে রয়েছেন। অপর শীর্ষ সন্ত্রাসী আগা শামীম পুরান ঢাকায় তার পছন্দের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছে। বিদেশে বসে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদেও মোবাইল ফোনে হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ধরনের সব প্রার্থীই আতংকে আছেন। দুবাই বসে শীর্ষ সন্ত্রাসী পুরান ঢাকার ওমর ফারুক কচি শ্যামপুরের আইজি গেট এলাকার ওয়ার্ডে তার পছন্দের একজনকে কাউন্সিলর প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। ওই প্রার্থীর পক্ষে কচির সহযোগীরা মাঠে নেমেছে। তার সেকেন্ড ইন কমান্ড এরফান। কচি নিজে ওই ওয়ার্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মোবাইল ফোনে প্রচারণা না চালানোর হুমকিও দিচ্ছে।
পুরান ঢাকায় কেন্দ্র দখলের পরিকল্পনা করছে ক্রসফায়ারে নিহত ডাকাত শহীদের সন্ত্রাসী বাহিনী। ডাকাত শহীদের সাবেক এক সহচর পুরান ঢাকার একটি ওয়ার্ডেও কাউন্সিল প্রার্থী। সন্ত্রাসী বাহিনী এ এলাকার কেন্দ্র দখলের পরিকল্পনা করছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বিদেশে পলাতক এবং কারাবন্দি শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আশীর্বাদপুষ্টরা স্থানীয়ভাবে একাধিক গ্রুপে ভাগ হয়ে নির্বাচনের মাঠ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা নিজেদের মধ্যে গোপন সমঝোতায় পৌঁছেছে। সবাই নিজ নিজ এলাকায় থাকবে। অন্য এলাকার বিষয়ে মাথা ঘামাবে না। যদি কেউ অন্য এলাকায় যায় তবে আগে থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিকে অবহিত করতে হবে। এলাকাভিত্তিক গ্র“পগুলো হচ্ছে- উত্তরের ১ নম্বর ওয়ার্ডে সন্ত্রাসী জুয়েল, সানি, রাজু, ইমাম হোসেন, উত্তরার জুয়েল, তেজগাঁওয়ের রবিন, ইন্দিরা রোডের হেনরি, মগবাজার দিলু রোডের মনির, মতিঝিলের আনোয়ার, আরকে মিশন রোডের নাসির, ফকিরাপুলের সালাউদ্দিন, আলমগীর, কাকরাইলের আক্তার অন্যতম। ঢাকার দুই সিটিতেই এ ধরনের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ এবং আতংকিত প্রার্থীরা তাদের নিরাপত্তাহীনতার কথা রিটার্নিং অফিসারকে লিখিতভাবে জানাচ্ছেন। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হচ্ছে না।
ঢাকা উত্তরের ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আলহাজ মো. নুরুল ইসলাম রতন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্র্থীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলেন। তিনি ১২ এপ্রিল ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ১২ এপ্রিল দুপুরে আমার কর্মীরা পোস্টার লাগাতে গেলে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সলিম উল্লাহ সলু ও তার সহযোগী সৌদি বাবু, আবদুর রাজ্জাক খান, আসলাম, ওলি, বিটু, মোহাম্মদ আলী, কালাম, নাসের অস্ত্র নিয়ে আমার কর্মীদের ওপর হামলা চালায় এবং কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। তিনি তার নির্বাচনী এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে দাবি করেন। অভিযোগ ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রার্থী সলিম উল্লাহ সলু বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা সম্পর্কে আমার জানা নেই। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম।
ঢাকা দক্ষিণের ৪১ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সারোয়ার হাসানের বিরুদ্ধেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থী রাশেদ রেজা রিজভী তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলেছেন। প্রার্থী রাশেদ বলেন, সোমবার বিকাল সাড়ে ৩টায় কর্মী ইসমাইল ও শুভ ভজহরি সাহা স্ট্রিটে মাইকে তার (রাশেদ) নির্বাচনী প্রচরণা চালাচ্ছিলেন। এ সময় প্রার্থী সারোয়ারের ক্যাডার জিকু তাদের প্রচার করতে বাধা দেয় এবং পোস্টার ছিঁড়ে ফেলে। প্রতিনিয়ত কর্মীদের প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ রাশেদের। ২৭ মার্চ জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেন রাশেদ। লিখিত অভিযোগে তিনি বলেন, ওয়ারীর আবদুর রহিম কমিউনিটি সেন্টারের সামনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সারোয়ার হাসান আলো আমাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। এই সারোয়ার এক সময় ডাকাত শহীদের সহযোগী ছিল। তিনি আরও জানান, গত ৩ দিন আগে তিনি চানখাঁরপুলে একটি হোটেলে খাচ্ছিলেন। এ সময় ঢাকা কলেজের এক ছাত্রলীগ নেতা তাকে হুমকি দেয়। ওই নেতা বলে, রাশেদ ভাই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নইলে ভোটের দিন বৃষ্টির মতো গুলি করা হবে। এ অবস্থায় তিনি নির্বাচনে কেন্দ্র দখলের আশংকা করছেন।
অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রার্থী সারোয়ার হাসান আলো বলেন, আমি ওকে (রাশেদ) ভালো করে চিনিই না। ওকে কেন হুমকি দেব। তাছাড়া ওকে তো আমি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। এলাকায় ওর কী কোনো ভোট আছে যে ও মাঠে থাকলে আমার সমস্যা হবে। তার ওপর হামলা করা প্রশ্নই আসে না। বংশালের এক কাউন্সিলর প্রার্থী অস্ত্র দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্র্থী ও তাদের কর্মীদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ওই এলাকার কেন্দ্র দখলের আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা।