|| মাসুদ রানা ||
জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিল্টার আবিষ্কর্তা হিসেবে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আজ লক্ষ্য করছি, খোদ জাফর ইকবালকে ফিল্টারে ঢুকিয়ে বাতিল ছাপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ঘটনা শুরু হয়েছে তাঁর উত্থানের স্থান সিলেট থেকে।
গতকালই দেখলাম, সিলেটে জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রধান ধারক আওয়ামী লীগের লোকদের মিছিল শুরু হয়েছে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে যে শেখ পরিবার কাল্ট আছে, জাফর ইকবাল অতীতে সেই কাল্ট করেও অদ্য শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে চ্যালেইঞ্জ করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শিবিরে জাফর ইকবাল নিজের তুল্যমূল্য হিসেব করতে ভুল করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলবেন, অথচ শেখ পরিবারের লোকদের পূজো না করে সমালোচনা করবেন, তা কি হয়? না, হয় না। রামকে অস্বীকার করে রামায়ণ পাঠ হয় না।
সিলেটের এমপি ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যাল্যের সিণ্ডিকেইট সদস্য মাহমুদুস সামাদ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জাফর ইকবালকে সিলেট-বিদ্বেষের অভিযোগে চাবকাবার সাধ প্রকাশ করলে, প্রাক্তন ছাত্র অনন্ত বিজয় দাশ শিক্ষকের পক্ষে ও এমপিকে বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ করে ফেইসবুকে পৌষ্টিং দিয়েছিলেনঃ
“সাংসদের চাবুক মারার কথা শুনে আমারও অধ্যাপক আজাদের মতো জানতে ইচ্ছে করে, আপনি কী পাস সেটা এখন আর জানার দরকার নেই, আপনি কী ফেল সেটাই না-হয় বলুন! মেধা-গুণ-বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার কোনো দিক দিয়ে যে অধ্যাপকের হাঁটুর কাছে বসার যোগ্যতা এদের নেই তারাই আবার ওই অধ্যাপককে চাবুক মারার কথা বলে! কলিকালের শিক্ষা একেই বলে! সাংসদ ক্ষমতার জোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট মেম্বার হয়েছেন, তাতেই লঙ্কা বিজয় করে ফেলেছেন ভাবখানা ধারণ করে আছেন! একটা অনির্বাচিত সংসদের মেম্বার হয়েছেন, যেখানে লজ্জায় আপনাদের বিনম্র হওয়ার কথা, তা-না, উল্টো আপনাদের অনির্বাচিতদের ক্ষমতার দম্ভ দেখলে মনে হয়, বেহায়া আর কাকে বলে! সাংসদ, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দোরগোড়ায় আপনি কখনো গিয়েছেন কি-না সেটা জানার দরকার নেই আমাদের, আপনি বরং প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষককের নাম বলুন, বেঁচে থাকলে ওই শিক্ষককে আমরা জিজ্ঞেস করতাম, শৈশবে এরকম একটা বেয়াদপকে শিক্ষা দিয়ে নিজের অর্থপ্রাপ্তি ঘটানোর চেয়ে আপনার বরং কৃষিকাজই উত্তম ছিল।”
তারপরই অনন্ত বিজয় দাশের খুন হওয়ার ঘটনাটিকে অনেকে তাঁর ঐ লেখার সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। অনন্ত বিজয় দাশ হত্যার প্রতিবাদে সিলেটে যে-কর্মসূচি পালিত হয়, জাফর ইকবাল সেখানে উপস্থিত ও মুখর ছিলেন। তাঁকে চাবকানোর এমপির সাধের বিরুদ্ধে তিনি কোনো বলেননি ঠিকই, কিন্তু ‘ব্লাগার হত্যা’ বিষয়ে নির্লিপ্ততা নির্দেশক সজীব ওয়াজেদ জয়ের মিডিয়া মন্তব্যকে হত্যাকারীদের প্রতি তাঁর নির্দেশ হিসেবে চিত্রিত করে বলেছেনঃ
“হত্যাকাণ্ডকে স্পর্শকাতর বিষয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় যে স্টেটমেন্ট দিয়েছেন তা মৌলবাদিদের জন্য একটা গ্রিন সিগনাল। জয়ের মন্তব্যে মনে হচ্ছে ‘তোমরা এভাবে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাও সরকার কিছুই করবো না।’ সরকার যেটা করছে এবং জয় যেটা বলেছে, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই।”
জাফর ইকবাল বুঝতে পারেননি, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র পরিমণ্ডলে শেখ পরিবারের কাউকে নিয়ে ন্যুনতম চ্যালেইঞ্জ গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র স্বর্গ থেকে কার্যতঃ তিনি বহিষ্কৃত হলেন। শীঘ্রই হয়তো উপর থেকে ঘুরতে ঘুরতে অভিশপ্ত ‘রাজাকার’ মাল্য তাঁর কণ্ঠে পতিত হবে। হয়তো তিনি রাজাকার কিংবা রাজাকার পুত্র হবেন আখ্যা পাবেন, যেভাবে পেয়েছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক পিয়াস করিম।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকারী অধ্যাপক পিয়াস করিম রাজাকার ছিলেন না। তথাপি মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ শ্রদ্ধার উদ্দেশ্যে শহীদ মিনারে নেওয়ার প্রস্তাব এলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ থেকে তাতে বাধা দেওয়া হয় তাঁকে ‘রাজাকারের ছেলে’ বলে নির্দেশ করে, যদিও আওয়ামী লীগের আইন মন্ত্রী ক’দিন পর সাক্ষ্য দিয়েছিলেন যে, মৃতের পিতা রাজাকার ছিলেন না। কিন্তু তাতে কী আসে যায়?
জাফর ইকবালও যে ‘রাজাকারের ছেলে রাজাকার’ হিসেবে আখ্যায়িত হবেন না, তা কীকরে নিশ্চিত বলি? ইতিমধ্যে সিলেট থেকে লেখক সৈয়দ মবনু ফেইসবুকে জাফর ইকবালের বংশ বৃত্তান্ত হাজির করে তাঁর পিতার ‘মুক্তিযোদ্ধা’ হওয়ার দাবী নিয়ে ১০টি বস্তুনিষ্ঠ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এই প্রশ্নগুলোর মধ্যে দু’টি বেশ জবরদস্তঃ
“৮) পাক হানাদারেরা বাংলার মানুষের উপর হিংস্র আক্রমণ করলো ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে। যুদ্ধ শুরু হলো ২৬ শে মার্চ থেকে। শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালের বাবা ফজলুর রহমান তো ৫ মে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঈমানদারির সাথে পাকিস্তান সরকারের সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন এবং এই দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় তিনি গুলিতে মারা যান। তিনি মুক্তিযোদ্ধা হলেন কীভাবে?
৯) কেউ যদি বলে, পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় সেখানের মুক্তিযোদ্ধারা তাকে হত্যা করেছে, তবে কি কথাটা ভুল হবে?”
জাফর ইকবাল এতোদিন রূপতঃ ভালোই চালাচ্ছিলেন স্রোতের পক্ষে নৌকো। অদ্য সেই স্রোতের ব্রিরুদ্ধে একটা বৈঠা মারাতেই ডুবতে শুরু করেছে তাঁর তরী। প্রশ্ন ও অনুসন্ধান যখন শুরু হয়েছে, তখন কেঁচো খুড়তে গিয়ে যে কোন সাপ বেরিয়ে পড়ে, আমরা কি তা জানি?
তিনি কেনো ১৯৭১ কেনো মুক্তিযুদ্ধ করেননি, সেই প্রশ্ন ‘অবভিয়াস’। তাই তিনি নিজেই আসমানী উত্তর তিনি দিয়েছে ‘সৃষ্টিকর্তা’র ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে। তিনি বলেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে কে যাবেন, তা নাকি সৃষ্টিকর্তাই ঠিক করেনঃ
“আমি বুঝতে শিখেছি, দেশের জন্যে যুদ্ধ করার সেই অবিশ্বাস্য গৌরব সবার জন্যে নয়। সৃষ্টিকর্তা অনেক যত্ন করে সৌভাগ্যবান কিছু মানুষকে তার জন্যে বেছে নিয়েছেন।…এই সম্মানটুকু সৃষ্টিকর্তা যাদের জন্যে আলাদা করে রেখেছেন শুধু তারাই তার প্রাপ্য, অন্যেরা নন।”
মুক্তিযুদ্ধের যাওয়ার বয়স থাকার পরও ‘সৃষ্টিকর্তার’ ইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে যাননি জাফর ইকবাল। কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিল্টার উদ্ভাবন করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে বেশি মুক্তিযুদ্ধ প্রেমিক হয়েছিলেন। তবে, যে-ফিল্টার তিনি উদ্ভাবন করেছেন, তার ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আমার মনে হচ্ছে, অধ্যাপক জাফর ইকবাল অনেকটা ম্যারি শ্যালির গল্পের সেই তরুণ বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনষ্টাইনের মতো, যাঁর তৈরি করা দানব শেষ পর্যন্ত তাঁকেও মারতে উদ্যত হয়।
হতভাগ্য জাফর ইকবাল অদ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফিল্টারে নিজেই পড়েছেন। তাঁর মনে রাখা প্রয়োজন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যদি ‘সৃষ্টিকর্তা’র ইচ্ছার বিষয় হয়েও থাকে, ২০১৫ সালে কিন্তু রাজাকার হওয়ার বিষয়টি কিন্তু আওয়ামী লীগের ইচ্ছায়ই হবে। সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধাচরণ করে জাফর ইকবাল সেই প্রক্রিয়াটাই শুরু করেছেন।
জাফর ইকবালের অগ্রজ প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদও নিজে মুক্তিযুদ্ধ থেকে দূরে থাকলেও “তুই রাজাকার” কথাটা আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর একটি নাটকে। “তুই রাজাকার” মানুষের বুলি ছিলো না। ছিলো মানবেতর পাখির বুলি।
নাটকে বেশ বিনোদন দিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এখন বাস্তব অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্ন জাগেঃ হুমায়ূন আহমেদের পাখির বুলি “তুই রাজাকার” কি এবার অনুজ জাফর ইকবালের প্রতিই উচ্চারিত হবে?
রোববার ১৭ মে ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড