জাল ভোট, কেন্দ্র দখল, সংঘর্ষ ও ব্যাপক অনিয়মের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকার দুই (উত্তর ও দক্ষিণ) সিটি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা ধরনের প্রশ্ন।
২০১৪ এর ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, পাঁচ সিটি নির্বাচন, ২০১৫ এর ২৮ এপ্রিল সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ একের পর এক প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে আস্থা হারাচ্ছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিশিষ্টজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ তা-ই মনে করছেন। এমনকি এভাবে চলতে থাকলে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার অন্যতম মাধ্যম নির্বাচনের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অনেকে মনে করছেন, ৫ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনের পর এবার নির্বাচন কমিশনের আস্থা ফিরিয়ে আনার একটা সুযোগ ছিল। কিন্তু ভোট জালিয়াতি ও কেন্দ্র দখলের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে বরং সরকারের ভাষায় কথা বলায় নির্বাচন ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষ আরও আস্থা হারিয়ে ফেলবে বলে মনে করছেন বিশিষ্টজনরা। এই নির্বাচন দেশের চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা বলেন, ‘সরকারি হস্তক্ষেপের কথা যতই বলা হোক, চূড়ান্ত দায় ইসির ওপর বর্তায়। সরকারের দোষ দিলে সরকার বলবে, নির্বাচন পরিচালনা করে ইসি। তাদের চাহিদামতো আমরা সব দিয়েছি। এছাড়া নির্বাচনের শুরু থেকে নানা কর্মকাণ্ড কিন্তু ইসির নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তাই দেশকে গণতন্ত্রের পথে নেয়ার জন্য ইসির যে দায়িত্ব আছে, সেই দায়িত্ব তারা সঠিকভাবে পালন করেছে কি না, সেটা নিয়ে লোকে অনেক দিন ধরে প্রশ্ন করতে থাকবে।’
নির্বাচনে দিন সকাল থেকেই গণমাধ্যমে সেসব ছবি, ভিডিও ও রিপোর্ট এসেছে তাতে এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন কমিশন ও স্বয়ং সরকার প্রধানের দাবি, নির্বাচন আগেরগুলোর চেয়েও সুষ্ঠু হয়েছে। এমন মিথ্যাচার জনগণকে চরমভাবে হতাশ করেছে। এছাড়া সরকার এই যে ভোটারবিহীন নির্বাচনের সংস্কৃতি চালু করলো তা অব্যাহত থাকলে দেশের গণতন্ত্র কোথায় গিয়ে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন বলেন, ‘সিটি নির্বাচন যা হয়েছে, গণমাধ্যমে সেটা সবাই দেখেছে। তবে নির্বাচনে যা ঘটেছে তা গণতন্ত্রের জন্য, সরকারের জন্য, মানুষের জন্য, নির্বাচন কমিশনের জন্য অর্থাৎ কারো জন্যেই ভালো হয়নি।’
এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভাবমূর্তি কতো নিচে নামলো, সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে আমার কিছু বলার নাই। তবে একটা কথা বলতে পারি, কমিশন কাজ করতে পারছে না। এতে করে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি ও নির্বাচনের ওপর মানুষের আস্থার ক্ষতি হচ্ছে।’
এদিকে সদ্য সমাপ্ত তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে বলেই মনে করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে যারাই প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করুক, ইসি নির্বাচনের মেইন প্লেয়ার। নির্বাচনে যত অনিয়ম হবে সব কিছুর জন্য ইসি দায়ী। ভালো হলেও তার দাবিদার ইসি।’
এ নির্বাচন নিয়ে আশাভঙ্গের কথা জানালেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইখতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচনকে নিয়ে আমরা খুব আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু যা হয়েছে তাতে খুব হতাশ হয়েছি। কিন্তু অবাক হয়নি। নির্বাচনে এক ধরনের ঝুঁকি ছিল এটা মাথায় নিয়ে কাজ করেনি ইসি ও প্রশাসন। দুটি দলের প্রার্থীরা যে প্রতিযোগিতায় নেমেছিল ইলেকশন কমিশন ও প্রশাসন সেটি ধরে রাখতে পারেনি। আমি মনে করি, এই নির্বাচনের পর এই সঙ্কট আরও ঘণীভূত হবে। সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের জেতাতে হবে যে কোএনা উপায়ে- প্রশাসনের এমন মনোভাব থেকেই হয়তো ভোটে এ ধরনের কারচুপি হয়েছে। বিএনপি যে ইস্যুতে নির্বাচন বয়কট করেছে সেটির একটি নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিৎ।’
এ নির্বাচনে ৯৯ শতাংশ কেন্দ্রেই অনিয়শ হয়েছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর সংগঠন ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি)। পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেমার সভাপতি মনিরা আক্তার বলেন, ‘সিটি নির্বাচন নির্দলীয় নির্বাচন। তবে এ নির্বাচনকে নির্দলীয় নির্বাচন রাখতে শুরু থেকে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফলে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন দলীয় নির্বাচনে রূপ নিয়েছে। প্রার্থীরা নিজে নির্বাচন না করে দলীয়ভাবে বর্জন করেছে। আমরা পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচনে দলীয় প্রভাবই দেখতে পেয়েছি। আর এ কারণে নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের যে হতাশাগ্রস্ততা তার দায়ভাব নির্বাচন কমিশনের ওপরেই বর্তায়।’
তবে আরেক পর্যবেক্ষক সংস্থা জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ নির্বাচনে কমিশনে ওপর সম্পূর্ণ দায় না চাপিয়ে কিছুটা বিএনপি ঘাড়েও দিলেন। অবশ্য অনিয়মের প্রসঙ্গটি প্রায় এড়িয়েই গেছেন। তিনি বাংলামেইলকে বলেন, ‘অনেক নির্বাচন পযবেক্ষণ করেছি। ঢাকা সিটি নির্বাচনকে নিয়ে মানুষেরর মধ্যে এবার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। তবে নির্বাচনে মাঝপথে বিএনপি বর্জন করলে মানুষ নির্বাচনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।’
নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইসি তো রেফারির দায়িত্বে ছিল। মাঠে যদি খেলোয়াড়ই না থাকে তাহলে রেফারি কী করবে বা তার কী বা করার আছে। নির্বাচনে অনিয়েমের ব্যাপারে ঢালাওভাবে নির্বাচন কমিশনকে দায়ী করা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাটা হচ্ছে, একটা ফুটবলের মতো, মাঝখানে বসিয়ে সবাই ইচ্ছেমত লাথি মারা। এখানে যদি একজন ফেরেস্তা বসিয়ে রাখা হয় সেও এই কাজটাই করবেন। এটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক কৌশল।’