ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সংবাদ সংগ্রহ গণমাধ্যমকর্মীরা পুলিশের নানামুখী প্রশ্নের শিকার। কখনো তারা বাধা মুখে পড়েছেন। কখনোবা তাদের পর্যবেক্ষণ কার্ডটিও টেনে ধরেছেন। গণমাধ্যমকর্মীদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও রয়েছে।
সংবাদ সংগ্রহের কাজে এ বাধা ও শারীরিকভাবে নির্যাতনের ঘটনাকে স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থী বলে মনে করছেন বিশিষ্ট সাংবাদিকগণ।
মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক উত্তম মঙ্গলবার দায়িত্ব পালন করছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে। সরকার সমর্থিত প্রার্থী এস এম ইমতিয়াজ খান বাবুলের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিকুল ইসলাম সেন্টু অভিযোগ আনেন। এ অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা উত্তমের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম কেন্দ্রের মধ্যে প্রবেশ করে। ওই সময় তাদের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীরা ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে এসআই উত্তম তাদের বাধা দেন।
সে সময় এসআই উত্তম গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, ‘ভেতরে কী হচ্ছে তা আমরা দেখব। কোনো সাংবাদিক ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। দু’জনের বেশী সাংবাদিক ভেতরে প্রবেশে নিষেধ আছে। দু’জন এমনিতেই ভেতরে রয়েছেন। তাই আর কেউ ঢুকতে পারবেন না।’
এ সময় সাংবাদিকরা ৫ জন করে সাংবাদিক কেন্দ্রে প্রবেশের অনুমতি আছে জানালে উত্তম বলেন, ‘আমাকে এমন নির্দেশ দেওয়া হয়নি। আপনার যে যেভাবে পারেন যত উপরে ফোন দিন। আমি ঢুকতে দিব না। আমাদের সহযোগিতা করুন। লিখে দিন নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে। আর সহযোগিতা না করলে আমরা খারাপ আচরণ করতে বাধ্য হব।’
পুলিশের বাধায় সাংবাদিকরা কেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিলে কাউন্সিলর প্রার্থী সেন্টুর সমর্থকরা সব কেন্দ্রে জাল ভোট হচ্ছে অভিযোগ করে এক যোগে কেন্দ্রের মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে। এ সময় সেখানে দায়িত্বরত র্যাব সদস্যরা প্রথমে তাদের প্রবেশ বাধা দেয়। র্যাবের বাধা উপেক্ষা করে কেন্দ্রের মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলে র্যাবের সদস্যরা সাধারণ ভোটারসহ সেন্টুর সমর্থকদের লাঠিপেটা করে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়। ওই ঘটনা ঘটার সময় কেন্দ্রে প্রবেশের সকল গেট ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা বন্ধ করে দেয়। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ভেতরে গেট খোলার অনুরোধ জানালে ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা অকথ্য ভাষা প্রয়োগ করে।
তারা বলেন, ‘সাংবাদিক করার সময় নাই। এখান থেকে ভাগেন, না হয় পিটাইয়া সরাব।’
ঢাকা সিটি উত্তর ২০ নম্বর ওয়ার্ডে সরকারী তিতুমীর কলেজের কলা ভবন প্রবেশের মুখে বকুল তলায় এক দল যুবক সংঘবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে ভবনের দ্বিতীয় তলায় ভোটগ্রহণ চলছিল। ভোটারদের উপস্থিতি কম দেখে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক কেন্দ্রের পরিবেশ দেখার জন্য ভিতরে প্রবেশের করার চেষ্টা করলে পুলিশ বাধা দেয়।
কারণ জানতে চাইলে দায়িত্বরত বনানী থানার উপ-পরির্দশক রাসেল বলেন, ‘প্রিসাইডিং অফিসারের নির্দেশ আছে ভিতরে সাংবাদিকদের প্রবেশ নিষেধ আছে।’ তার প্রতি উত্তরে গণমাধ্যমকর্মী ফররুখ বাবু এক পুলিশ অনুরোধ করেন প্রিসাইডিং অফিসারকে ডেকে দেওয়ার জন্য। তাতেও আপত্তি জানান ওই পুলিশ সদস্য; পরে কয়েজন এগিয়ে আসলে ভবনের দ্বিতীয় তলা প্রিসাইডিং অফিসারের কক্ষে যাওয়ার অনুমতি মিলে।
ঢাকা উত্তরের বাড্ডা হাই স্কুল, মানারাত ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, গুলশান মডেল কলেজসহ প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রেই প্রবেশে পুলিশ বাধা দেয়। এ ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচনে শান্তিপুর কলেজ, খিলগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ আরও বেশ কয়েকটি কেন্দ্র প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়।
এদিকে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে মঙ্গলবার ঢাকা দক্ষিণ সিটি নির্বাচন এলাকায় সবুজবাগে বাসাবো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে রাইজিং বিডির নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াসিন রাব্বী গুলিবিদ্ধ হন। এ ছাড়া দৈনিক যুগান্তরের একজন প্রতিবেদককে কমলাপুরে মারধর করেছেন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা। প্রথম আলোর একাধিক সাংবাদিকশারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন। ঘটনাস্থলে উপস্থিত পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
সিটি নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত একাধিক গণমাধ্যমকর্মী অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে কোথাও চূড়ান্ত বাধা, আবার কোথাও হামলার শিকার হতে হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের উপস্থিতিতে ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের কথাও শুনতে হচ্ছে। পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতাকর্মীদের এমন অবস্থান ভোট কেন্দ্রের ভিতরের অবস্থাও জানান দেয়।’
একটি ইংরেজি দৈনিকের নিজস্ব এক প্রতিবেদক বলেন, “পুলিশের উপস্থিতে রামপুরা একরামুন নেসা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুপুর আড়াইটার দিকে পুরুষ কক্ষের সামনে এক যুবক ঘুরাঘুরি করছিলেন। কক্ষের সামনে থাকা আনসার সদস্য এগিয়ে এসে তার পরিচয় জানতে চান। এর মধ্যেই হাজির আর দুই-তিনজন। তাদের দেখে মনে হল, তারা ক্ষমতাসীন দলেরই কেউ। আমি কাছ থেকে তাদের কথোপোকথন শুনছিলাম। যুবককে জিজ্ঞাস করা হল, ‘এই তুমি কে? উত্তর এল, ‘আমি ভোট দিতে আইসি, নম্বর জানি না। পাল্টা উত্তর এল, ‘ঠিক আছে নম্বর জানা লাগবে না। ঘড়ি মার্কায় ভোট দিলে নম্বর জানা লাগবে না। আস ব্যবস্থা করছি।’”
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাংবাদিক সালিম সামাদ বলেন, ‘প্রতি নির্বাচনের সময় সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এটা নতুন নয়। তবে এবার ব্যাপকভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। যে সব কেন্দ্রে গণ্ডগোল হয়েছে সাধারণত সে সব কেন্দ্রে সাংবাদিকদের বাধা দেওয়া হয়েছে। যাতে ওই সব কেন্দ্রে সংবাদ সংগ্রহ করতে না পারে। যারা কাজে বাধা দেন তারা রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর। এ ধরনের ঘটনা স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে সাংবাদিকদের দেওয়া কার্ডের মধ্যেই উল্লেখ থাকে একজন সাংবাদিক কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না। তারপরও সাংবাদিকদের ইচ্ছাকৃতভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। সাংবাদিক সংগঠনগুলো হয়রানি ঘটনায় কোনো শক্ত প্রতিবাদ করতে পারায় প্রতি বছরই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। এখনই সময় সাংবাদিক হয়রানি বন্ধের প্রতিবাদ করার।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি শাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, ‘এবার ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপেরে শামিল। কারণ নির্বাচন কমিশনের অনুমতিপত্র নিয়েই সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়েছিল। তাই নির্বাচন কমিশনের উচিত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা।’
বিশিষ্ট সাংবাদিক নাঈনুল ইসলাম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাজে বাধা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, সেখানে এমন কিছু ঘটছিল, যা অন্যায়। এ ধরনের ঘটনা স্বাধীন গণমাধ্যমের পরিপন্থী। এ ব্যাপারে সাংবাদিক সংগঠনগুলো ও হয়রানি শিকার হওয়া সাংবাদিকদের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদ করা উচিত। না হলে সাংবাদিকতার ওপর প্রতিবারই প্রতিঘাত নেমে আসবে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘এ ঘটনা সত্য নয়। নির্বাচন কমিশন থেকে যে সব সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষক কার্ড দিয়েছে তাদের কোনো বাধা হয়নি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি নিজে কন্টল রুম থেকে নির্দেশনা দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন থেকে নমুনা দেওয়া হয়েছে, তা দেখে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়। তারা যেন অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের নিয়ম মেনে চলেন।’