৬ই মার্চ রাত ১০টা। রাজধানীর আদাবর ১২ নম্বর রোডের বাসা থেকে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যায়। এরপর র্যাব-পুলিশের দপ্তর থেকে আদালতপাড়া, হাসপাতালের মর্গ থেকে নদীরপাড়। সব জায়গায়ই পাঁচ মাসের শিশুকে নিয়ে স্বামীকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন শাহ ইসরাত আজমেরী। কোথাও স্বামীর সন্ধান পাচ্ছেন না তিনি। উল্টো শিকার হচ্ছেন নিষ্ঠুর রসিকতার। প্রায় দিনই অজ্ঞাত পরিচয়ে তার মোবাইলে ফোন দিয়ে বলা হচ্ছে, ওমুক থানায় একটি লাশ পাওয়া গেছে, তমুক এলাকায় একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে- সেটি আপনার স্বামীর কিনা একটু খোঁজ নেন। এমন নির্মম রসিকতার শিকার হচ্ছেন নিখোঁজ বিএনপি নেতাদের প্রতিটি পরিবারই। নিখোঁজ আনিসুর রহমান তালুকদার খোকনের স্ত্রী ইসরাত আজমেরী বলেন, ৬ই মার্চ রাতে পাঁচ মাস বয়সী শিশুকন্যাকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এসময় বাসার কলিংবেল বেজে উঠে। খোকন দরজা খুলে দিলে ডিবি পুলিশের পরিচয় দিয়ে কয়েক ব্যক্তি বলেন, আপনাকে আমরা নিতে এসেছি। তারা তাকে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমার আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে ডিবি কার্যালয় ও র্যাব সদর দপ্তরে খোঁজ নেই। কিন্তু কোথাও তার সন্ধান পাচ্ছিলাম না। এরপর আদাবর থানায় জিডি করতে যাই। ইসরাত আজমেরী বলেন, জিডির কপিতে খোকনকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে লিখতে চাইলে বাধা দেয় দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা। তখন ওই পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে বলেন, এভাবে লিখলে আপনার জিডি নেবো না। বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর ফিরেনি- এভাবে নিখোঁজের জিডি লেখার পরামর্শ দেন। অসহায় আজমেরী পুলিশ কর্মকর্তার কথামতো নিখোঁজের জিডি করেন। এরপর স্বামীর সন্ধান দাবিতে হাইকোর্টে আবেদন দায়ের করেন আজমেরী। এরপর প্রতিদিনই পুলিশ, র্যাব ও ডিবি কার্যালয়ে স্বামীর খোঁজে হন্যে হয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। কিন্তু কোথাও স্বামীর সন্ধান পাচ্ছেন না। বাবার সঙ্গে অবুঝ দুই কন্যার সময় কাটার স্মৃতি তুলে ধরে আজমেরী বলেন, আমার বড় সন্তান জায়রা রহমান তৃধার বয়স সাড়ে তিন বছর। আর ছোট সন্তান জায়না রহমান নিধার বয়স সাড়ে পাঁচ মাস। ছোট সন্তান জন্মের পর থেকে তৃধা বাবার কাছে বেশি থাকতো। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে খোকন বাসায় থাকতো না। কিন্তু আদুরে কন্যাদের টানে প্রায়সময়ই রাতে বাসায় চলে আসতো খোকন। রাতে বাবার সঙ্গেই ঘুমাতো তৃধা। বাবার সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠতো সাড়ে পাঁচ মাস বয়সী নিধাও। এখন রাত হলেই বাবাকে খোঁজে অবুঝ দুই কন্যা। দিনের বেলায় অনেক সময় খোকনের জন্য কান্নাকাটি করলে তৃধা আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, চিন্তা করো না- আমি বলেছি না, আমি বাবাকে চাই। ওরা আমার বাবাকে ফেরত দিবে। খোকনের স্ত্রী বলেন, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝিতে প্রায়ই সাদা পোশাকের ডিবি পুলিশ বাসার সামনে আসতো। কিন্তু কোনদিন বাসায় ঢুকেনি। ফেব্রুয়ারিতে না এলেও মার্চের শুরুতে ফের খোকনের গতিবিধিতে নজর রাখছিল পুলিশ। কিন্তু কোনদিন কল্পনা করতে পারিনি ধরে নিয়ে একেবারে নিখোঁজ করে দেবে। অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে নিষ্ঠুর রসিকতার ঘটনা তুলে ধরে ইসরাত আজমেরী বলেন, কয়েকদিন আগে কক্সবাজার থেকে আমার মোবাইল নাম্বারে ফোন করে থানা পুলিশের পরিচয় দিয়ে বলেন, এখানে কয়েকজনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে আপনার স্বামীর লাশ আছে কিনা এসে দেখে যান। পরদিন নরসিংদী থানা পুলিশের পরিচয় দিয়ে আরেকটি নাম্বার থেকে আমার মোবাইলে ফোন দেয়া হয়। তারা আমাকে জানান, নরসিংদী জেলা সরকারি হাসপাতালে একটি মরদেহ রয়েছে। সেটি দেখতে আপনার স্বামীর মতোই। ওইসময়ে নিজেদের মানসিক অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, এরপরও আমার এক নিকটাত্মীয় দিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি- ওই মৃতদেহ খোকনের নয়। একইভাবে ময়মনসিংহ থেকে একটি অজ্ঞাত নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে আমাকে বলেন, এখানে একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হয়েছে। সেটি আপনার স্বামীর কিনা খোঁজ নেন। এদিকে খোকনের ছোটভাই ইমরান বলেন, ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমার বৃদ্ধ বাবা-মা পাগলপ্রায়। ক্ষণে ক্ষণে ফোন করে ছেলের খোঁজ জানতে চান তারা। কিন্তু তাদের মিথ্যা সান্ত্বনা দিতে হয়। ভাইয়ের চিন্তার আমাদের পরিবারের সবারই অস্থির সময় কাটাচ্ছেন।