আগামী বুধবারই বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে তার গুলশানের কার্যালয় থেকে গ্রেফতারের নামে সরকার জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়ার চিন্তাভাবনা করছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির একাধিক নেতা বলেন, সেদিন খালেদা জিয়ার আদালতে হাজিরা দেয়ার দিন ধার্য করা আছে। খালেদা জিয়া যদি সেদিন স্বেচ্ছায় আদালতে যান সেক্ষেত্রেও তাকে কার্যালয়ে প্রবেশের কোনো সুযোগ দিবে না সরকার। অন্যদিকে যদি তিনি আদালতে না যান সেক্ষেত্রেও সরকারের হাতে রয়েছে আদালতের নির্দেশনা। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির নির্দেশকে কাজে লাগিয়ে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জোর করে খালেদা জিয়াকে কার্যালয় থেকে বের করে নিয়ে যাবে। এরই মধ্যে আদালত তার কার্যালয়ে তল্লাশি করার অনুমতি প্রদান করেছে বলে জানা গেছে। এখন শুধু অপেক্ষার পালা। সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া তার গুলশানের কার্যালয়েই থাকবেন। চলমান অবরোধের পাশাপাশি হরতালের কর্মসূচি থাকায় তিনি কোথাও যাবেন না। তাকে বের করতে হলে গ্রেফতারই করতে হবে। তিনি গ্রেফতার হওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। যে সরকারের হাতে তিনি তার বাসা থেকে এক কাপড়ে বের হয়ে এসেছেন, যে সরকার তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে, যে সরকার তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে, তাদের হাতে গ্রেফতার হওয়াটাকে তিনি স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করছেন।
জানা গেছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে পুলিশী তল্লাশির নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল রোববার ঢাকার সিএমএম আদালত ওই নির্দেশ দেন। গুলশান থানার ২৫ (২) ১৫ (হত্যাচেষ্টা) মামলায় এ আদেশ দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে তল্লাশির আদেশ দেয়া হয়েছে এমন একটি খবর আদালতে অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকরা এ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট মামলার জিআর শাখায় হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও ওই মামলার কোনো নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবং জিআর শাখা, ডেসপাচ শাখা এবং সংশ্লিষ্ট আদালতের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি।
আদালতের একটি সূত্র জানায়, গুলশান থানার ওই মামলায় এজাহারনামীয় ১৪ জন আসামী খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয়ে লুকিয়ে আছেন এবং সেখানে নাশকতার জন্য বিস্ফোরক দ্রব্য থাকতে পারে এমন সন্দেহের ভিত্তিতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কার্যালয়ে তল্লাশির জন্য আদালতে অনুমতি প্রার্থনা করেন। শুনানি শেষে বিচারক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এসএম মাসুদ জামান তল্লাশির অনুমতি দিয়ে আদেশ দেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকটি সূত্র থেকে জানা গেছে, জিয়া অরফানেজ এবং জিয়া চ্যারিটেবল দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সেই মামলায় খালেদা জিয়ার বাসভবনের ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তিনি সেখানে না থাকায় এবং তিনি বর্তমানে গুলশানের দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করছেন জানা থাকলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতার করতে পারছে না। সেজন্য আইনগতভাবে তার অবস্থান নির্ণয় ও সেখানে প্রয়োজনে প্রবেশ করে তাকে যাতে গ্রেফতার করা যায় সেজন্য ওই কার্যালয়ে খালেদা জিয়া অবস্থান করছেন মর্মে আদালতে একটি প্রতিবেদন পাঠিয়ে সেখানে তল্লাশি চালানোর আদেশ প্রার্থনা করেছেন সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এই প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে আদালত এই আদেশটি দিয়েছেন বলে ওই সূত্রটি জানায়। তবে জিআর, ডেসপাচ, সংশ্লিষ্ট আদালতের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী স্বীকার বা অস্বীকার করেননি। এ বিষয়ে ঢাকার সিএমএম বিকাশ কুমার সাহার সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সূত্র মতে, আগামী ৪ মার্চের বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কথিত দুর্নীতির দুই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের কথা রয়েছে। পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদরাসা মাঠে বিশেষ জজ আদালতে তিনি যাবেন কি যাবেন না, তা নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। কিন্তু নেতা-কর্মীদের থেকে কার্যত বিচ্ছিন্ন থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ৫৮ দিন ধরে গুলশান কার্যালয়েই অবস্থান করছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে এমন অভিযোগ বিএনপির। এ অবস্থায় তিনি আদালতে যাবেন, নাকি তাকে গ্রেফতার করা হবে সেদিকে তাকিয়ে আছে সবাই। ৪ মার্চের এই দিনটিকে নিয়ে আলোচনা আছে সরকারি মহলেও।
খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, নির্ধারিত তারিখে তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করবেন কিনা, সে ব্যাপারে দলীয় আইনজীবী ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তারা বলছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে সেটি অবৈধ। মূলত তাকে তার গুলশানের কার্যালয় থেকে বের করার জন্যই সরকার আদালতকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছে। তবে পুলিশ যদি আদালতের আদেশ অনুযায়ী যদি তাকে গ্রেফতার করে সে বিষয়টি নিয়েও ভাবছে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম।
সূত্র জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ দিনটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। সরকার পক্ষ মনে করছে, বিএনপি চেয়ারপার্সন স্বেচ্ছায় ওই দিন আদালতে যাবেন। এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে তারা বেগম জিয়াকে আর গুলশানের কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দিবে না। তাহলে দেশে-বিদেশে এটা নিয়ে সমালোচনা কম হবে। কিন্তু যদি তা না করে গুলশান কার্যালয়েই অবস্থন করেন, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে কার্যালয় থেকে বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করে আদালতে নেয়া হবে। পরে তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনাও চলছে। এতে সমালোচনা বেশি হলেও সরকার বেগম জিয়াকে কার্যালয় থেকে মঙ্গলবারই বের করার চেষ্টা চালাবে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আদালতে যাওয়ার প্রশ্নে দলের ভিতরে নানা আলোচনা আছে। তবে খালেদা জিয়ার মনোভাব অত্যন্ত শক্ত। তিনি বলেছেন, মিথ্যা ঘটনা সাজিয়ে মামলা করা হয়েছে। হয়রানি করার জন্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। এ মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, চেয়ারপার্সন জামিন নিতে আদালতে যাবেন কিনা, তার কৌশল নির্ধারণে সিনিয়র আইনজীবীরা খুব শিগগিরই বৈঠক করবেন। এর আগে তার আদালতে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর ওইদিন রাতেই বিচারপতি টি এইচ খানের বাসায় বৈঠকে এ নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন বিএনপি সমর্থিত সিনিয়র আইনজীবীরা। গ্রেফতারি পরোয়ানা কিংবা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্তের পেছনে সরকারের কী কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে তা নিয়েও আলোচনা হয়। বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেন, গুলশান কার্যালয়ে তালা ঝোলানো ছাড়াও সারা দেশে ২০ দলের নেতা-কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্যই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। একইভাবে ঢাকা সফরকালে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সাক্ষাৎ বিঘ্নিত করারও উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
সূত্রমতে, আন্দোলন প্রশ্নে অনড় অবস্থানে থাকা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া যে কোনো পরিস্থিতিতেই গুলশান কার্যালয়ে থাকতে চান। এ সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়তে নারাজ তিনি। তাই দুর্নীতির দুই মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়ার বিরুদ্ধে জামিন চাইতে আদালতে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। আদালতে জামিন চাইতে গেলে কার্যালয়ে ফিরতে না পারার আশঙ্কা বিএনপির নীতিনির্ধারকদের। দলের আরেকটি সূত্রের মতে, চলমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা বা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনতে খালেদা জিয়াকে নানাভাবে চাপে রাখার কৌশল এটি। তাকে গুলশান কার্যালয়ের বাইরে নিতে পারলে সেখানে ফিরতে দেওয়ার সম্ভাবনা নেই। ওই কার্যালয়ে তালা লাগিয়ে বাসায় যেতে বাধ্য করা হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা বারবার বলে আসছি সরকার অবরুদ্ধ খালেদা জিয়াকেও ভয় পাচ্ছে। সরকার শুরু থেকেই চাচ্ছে খালেদা জিয়া গুলশান কার্যালয় ছেড়ে যান। কয়েকজন মন্ত্রীও একাধিকবার এ বিষয়ে হুমকি ধমকিও দিয়েছেন। তারা কার্যালয়ের সামনে নাশকতার চেষ্টাও করেছেন। তবে খালেদা জিয়া এখানে স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করছেন। গুলশান কার্যালয়ে থেকেই তিনি প্রায় দুই মাস ধরে সারা দেশে আন্দোলন পরিচালনা করছেন। তাছাড়া পত্র-পত্রিকাসহ মিডিয়াতে তাকে গ্রেফতারের কথা শোনা যাচ্ছিল, তারই প্রত্রিক্রিয়া হতে পারে এই গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি। কিন্তু খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার কিংবা আদালতের মাধ্যমে সাজা দিলেও আন্দোলন বন্ধ হবে না। বরং আন্দোলনের মাত্রা আরও বাড়বে।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে তা জটিলতা আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের একজন আইন প্রণেতা। যিনি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। বৃহস্পতিবার ব্রাসেলসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টকে ইয়োসেফ ভাইডেন হোলজার জানান, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও এখনও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। তিনি বলেন, আমি শঙ্কিত যে তা বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার তীব্রতা আবার না বাড়িয়ে দেয়। গ্রেফতার করা হলে তা জটিলতা বাড়িয়ে দেবে। অবশ্য এর আগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।