দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ লাইন মাঠ থেকে সরাসরি পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ১০ হাজার পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ শুরু হচ্ছে আজ। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে এই বিপুলসংখ্যক কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে মাত্র পাঁচ দিনেই। আর কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও শুরু হয়েছে নজিরবিহীন তদবির বাণিজ্য। মন্ত্রী-এমপিরা চিরকুটে নামের তালিকা পাঠাচ্ছেন। ক্ষমতাসীন দলের থানা পর্যায়ের নেতারাও ছুটছেন প্রার্থীদের তালিকা নিয়ে। তাদের এই ছোটাছুটি আর তদবিরে দিশাহারা জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুলিশ সদর দফতরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীদের আর্থিক লেনদেনে জড়িত না হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তদবির করলে তা প্রার্থীর চরম অযোগ্যতা হিসেবে গণ্য করা হবে। কিন্তু পুলিশ সদর দফতরের এই নির্দেশনা কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। বেশ কয়েকজন এসপির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী পুলিশ কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য এসপিদের মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। এ নিয়ে এসপিরা মনোক্ষুণ্ন হলেও তারা প্রকাশ করছেন না। শারীরিক মাপ এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে ও তালিকা মতো নিয়োগ দেওয়া হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছেন।
কয়েকজন প্রার্থীর অভিভাবক জানান, স্থানীয় এমপির ডিও আনতে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সে অনুযায়ী তাদের চাকরির শতভাগ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ সদর দফতর বলছে, কনস্টেবল নিয়োগে কোনো দুর্নীতি হচ্ছে না। এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মোখলেসুর রহমান বলেন, নিয়োগ নিয়ে কোনো ধরনের তদবির বা সুপারিশের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে বলেও জানি না। সংশ্লিষ্টদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ করা যাবে না। নিরপেক্ষভাবে যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। তবে কিছু প্রতারক চক্র রয়েছে, তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে পুলিশকে। নিয়োগে মুক্তিযোদ্ধা কোটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন কোটা রয়েছে। তবে সুপারিশ বা তদবিরে কারও জন্য কোনো কোটা নেই বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বর্তমান সরকার পুলিশ বাহিনীতে নতুন ১০ হাজার কনস্টেবল নিয়োগের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে ৮৫০০ জন পুরুষ ও ১৫০০ জন মহিলা পুলিশ রয়েছে। প্রথম দিন আজ মঙ্গলবার ঢাকাসহ ১৩টি জেলায় শারীরিক ও লিখিত পরীক্ষার মধ্য দিয়ে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাকি জেলাগুলোতে অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৯, ২৩, ২৫ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সূত্র জানায়, জেলার মন্ত্রী, মন্ত্রী মর্যাদার কর্মকর্তা, এমপি, সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কনস্টেবল পদে নিয়োগের জন্য এলাকাভিত্তিক তালিকা দিচ্ছেন। কোনো কোনো জেলায় জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের আধা সরকারি পত্রে নিয়োগের জন্য তালিকা দিয়ে এমপিরা পুলিশ সুপারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। এসপিদের ফ্যাঙ্ওে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে ডিও লেটারের তালিকা। এ ছাড়াও তদবিরের তালিকায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগের মন্ত্রী এবং কর্মকর্তারাও পাঠাচ্ছেন তালিকা। এমপিরা নিজ এলাকার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কোটার চেয়ে বেশি নিয়োগের তালিকা ধরিয়ে দিয়ে এসপিদের চাপ দিচ্ছেন বলে অনেকেই অভিযোগ করছেন। সূত্র জানায়, চাকরির প্রত্যাশায় প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের প্রার্থীরা ধরনা দিচ্ছেন এমপি-মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ লোকদের বাসায়। নিয়োগের নিশ্চয়তা দিয়ে তারাই ঘুষের দরদাম হাঁকাচ্ছেন। অভিযোগ রয়েছে, পুলিশ নিয়োগে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হচ্ছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় একই অবস্থা। সিলেট বিভাগের একটি জেলার এসপি বলেন, রাজনৈতিক তদবির থাকবেই এ ধরনের নিয়োগে। কিন্তু নির্দিষ্ট কোটা পূরণের পর অতিরিক্ত নামের তালিকা হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একটি জেলায় এমপি রয়েছেন কয়েকজন। প্রত্যেকেই অতিরিক্ত নামের তালিকা ধরিয়ে দিচ্ছেন। এতে করে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রাজশাহী বিভাগের একটি জেলার এসপি আক্ষেপ করে বলেন, তদবির অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে করে যোগ্য লোকেরা নিয়োগে বঞ্চিত হচ্ছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কনস্টেবল নিয়োগের রাজনৈতিক তদবিরে অধিকাংশ জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) অতিষ্ঠ এবং দিশাহারা। এ কারণে এসপিরা গুরুত্বপূর্ণ ফোন ছাড়া এখন ফোন কম ধরছেন। অনেক এসপি তদবিরের চাপে অতিষ্ঠ হয়ে কখনো কখনো ফোন বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ নিজেরা ফোন না ধরে অন্য কাউকে দিয়ে ফোন ধরাচ্ছেন। কোনো তদবিরে অংশ নেননি এমন প্রার্থীরা হতাশ। তাদের কয়েকজন অভিযোগ করেন, পুলিশ লাইন মাঠে নিয়োগের বাছাই করা হলেও দুই তিন দিন আগেই তদবিরের তালিকা অনুয়ায়ী নিয়োগ সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন শুধু আনুষ্ঠানিকতা মানা হবে। পুলিশ সদর দফতরের রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড ক্যারিয়ার প্ল্যানিং বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রার্থীদের নিজ নিজ জেলার পুলিশ লাইন মাঠে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। সেখানে শারীরিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের একই দিনে ৪০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের একই দিনে অথবা পরবর্তী সময়ে নির্ধারিত সময়ানুযায়ী মনস্তাত্তি্বক ও মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। নির্বাচিত হলে পুলিশ ভ্যারিফিকেশন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কনস্টেল হিসেবে প্রশিক্ষণের জন্য যোগ্য বিবেচিত হবেন। সূত্র জানায়, সবচেয়ে বেশি কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে ঢাকা জেলায়। এই জেলায় এবার নেওয়া হচ্ছে পুরুষ ও মহিলাসহ ৬৯৬ জন। আর সবচেয়ে কম নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে বান্দরবান জেলায়। এই জেলায় পুরুষ ও মহিলাসহ নিয়োগ দেওয়া হবে ২৪ জনকে।